ইতিহাসের পাঠ:
ঐতিহাসিক খেমকারান যুদ্ধ: যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের উদ্ভব
, ০২ জুমাদাল ঊলা শরীফ, ১৪৪৭ হিজরী সন, ২৬ খমীছ, ১৩৯৩ শামসী সন , ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রি:, ০৯ কার্তিক, ১৪৩২ ফসলী সন, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) ইতিহাস
১৯৬৫ সালের আগষ্ট মাসে ভারত-পাকিস্তান উভয়েই বুঝতে পারলো একটা যুদ্ধ অনিবার্য। যুদ্ধ কৌশল হিসাবে পাকিস্তান কাশ্মীরের শ্রীনগর অভিমুখে তার সেনাবাহিনী পাঠাতে থাকে। সেনাবাহিনীর কনভয়ের প্রথমে থাকে পাকিস্তানের তৎকালীন দুর্ধর্ষ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, তারপর বালুচ রেজিমেন্ট, ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং সবশেষে থাকে তৎকালীন বেঙ্গল রেজিমেন্ট যা মূলতঃ পূর্ব বাংলার সেনাসদস্য দ্বারা গঠিত।
ওদিকে ভারত তার বাহিনী শ্রীনগরে না পাঠিয়ে শিয়ালকোটের অরক্ষিত খেমকারান দিয়ে পাকিস্তানের লাহোর অভিমুখে মার্চ করায়। ওই মুহূর্তে শিয়ালকোট ছিলো পুরোই অরক্ষিত। ঘটনার আকস্মিকতায় পাকিস্তান হতচকিত হয়ে যায়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব নিজ হাতে সেনাবাহিনীর কমান্ড নেন। শ্রীনগর অভিমুখে মার্চ করা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মুখ ঘুরিয়ে তিনি খেমকারান অভিমুখে পাঠান।
শ্রীনগর অভিমুখে যে দল ছিলো সব থেকে পেছনে সেই দলই হয়ে যায় এখন অগ্রবর্তী দল। মানে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন সবার আগে তার পেছনে যথাক্রমে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, বালুচ রেজিমেন্ট আর সর্বশেষে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মুখোমুখী হয় সে সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অবহেলিত ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানী খেমকারান সেক্টরে মুখোমুখি হয় সপ্তদশ রাজপুত উনবিংশ মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি, ষোড়শ পাঞ্জাব এবং সপ্তম লাইট ক্যাভালরির।
ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান নামে বাংলাদেশের এক বীর সন্তান ইষ্ট বেঙ্গল আলফা কোম্পানীর নেতৃত্বে ছিলেন। ক্যাপ্টেন জিয়ার ওপর নির্দেশ ছিলো যতক্ষণ না মূল বাহিনী মানে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আর বালুচ রেজিমেন্ট খেমকারান সেক্টরে না আসে ততক্ষণ যেন রক্ষনাত্মক (আত্মরক্ষামূলক) ভূমিকা নেয়া হয়। কিন্তু যে মানুষটা জন্ম নিয়েছে ইতিহাস তৈরী করার জন্য সে কিভাবে আত্মরক্ষামূলক ভূমিকা নিবে? ক্যাপ্টেন জিয়া ফরমানের তোয়াক্কা না করে প্রচন্ড আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা পাড়ের দামাল ছেলেরা ঘূর্ণিঝড়ের মত খেমকারান সেক্টরে ভারতীয় বাহিনীকে ঝড়া পাতার মত উড়িয়ে দিলো। হতভম্ভ হয়ে গেলো ভারতীয় বাহিনী। ব্রিটিশদের দেয়া নন মার্শাল রেস থেকে এক নিমেষে হয়ে বাংলাদেশীরা বিশ্ব মানচিত্রে দামাল যোদ্ধা হিসাবে পরিচিতি পেয়ে গেলো। পাকিস্তানী পত্রিকাগুলো মেতে উঠলো বাংলাদেশীদের প্রশংসায়।
ওই সময় যদি ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল ভারতীয়দের গুড়িয়ে না দিতো তবে পাকিস্তানের রাজধানী লাহোর সেই রাতেই ভারতের পদানত হয়ে যায়। নাউযুবিল্লাহ!
যুদ্ধে দুর্ধর্ষ সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য যেসব কোম্পানী পুরস্কৃত হয়, তার ভিতরে তার কোম্পানিটিও ছিলো। পাকিস্তান সরকার তাকে ‘হিলাল-ই-জুরাত’ খেতাবে ভূষিত করে। এছাড়াও তার সেনাদল বীরত্বের জন্য দুটি ‘সিতারা-ই-জুরাত’ এবং নয়টি ‘তামঘা-ই-জুরাত’ পুরস্কার লাভ করে। যুদ্ধের এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সপ্তম ইষ্ট বেঙ্গল পর্যন্ত ব্যাটেলিয়ান তৈরী হয়। যুদ্ধের পরপরই জাতীয় কবি নজরুলের “চল চল চল উর্ধ্বে গগনে” কবিতাটি তাদের মার্চ পাষ্ট কথন হিসাবে স্বীকৃত পায়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা মাওলানা ভাষানী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতাদের পশ্চিম পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানানো হয় সেনাবাহিনীর মার্চপাষ্টে সালাম গ্রহণের জন্য। আর ভাষানী তখন পশ্চিম পাকিস্তানকে “ওয়ালাইকুম আস সালাম” বলে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
যুদ্ধ যে কখনো কখনো কোন জাতি-গোষ্ঠী বা আঞ্চলিক মহাজাগরণের কারণ হয় তার উদাহরণ বিরল নয়। তারই ধারাবাহিকতায় ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ ইষ্ট বেঙ্গলের বিজয় গাথা বাংলাদেশীদের সুপ্ত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য এক জাদুর কাঠি হিসাবে কাজ করে।
-মুহম্মদ মুশফিকুর রহমান।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কেমন ছিলো মোঘল সালতানাতের গোলন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
পান্থনিবাস ও সরাইখানা নির্মাণে মুসলমানদের অনবদ্য অবদান
২৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৯)
১৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার বিরোধিতায় বিধর্মী-অমুসলিমরা
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার হিন্দু ধনিক-বণিক, বেনিয়া শ্রেণী, ব্যাংকার প্রভৃতির সাথে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইউরোপকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন আফ্রিকান মুসলমানরা
১২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
গুজরাটের সুলতান মুজাফফর শাহের পরহেজগারিতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ
০২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৭)
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
কেমন ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ঐতিহাসিক মুসলিমবাগ ঈদগাহ-ই কি আজকের ঢাকেশ্বরী মন্দির?
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
১২টি চন্দ্রমাসের নাম এবং নামকরণের সার্থকতা (২)
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৬)
২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)












