ইতিহাস
‘মরুভূমির চিতা’ ফখরুদ্দীন পাশা: মদীনা মুনাওয়ারার সর্বশেষ উসমানী শাসক
গত ১লা ছফরের পর......
, ১৬ ছফর শরীফ, ১৪৪৭ হিজরী সন, ১২ ছালিছ, ১৩৯৩ শামসী সন , ১১ আগস্ট, ২০২৫ খ্রি:, ২৮ শ্রাবণ, ১৪৩২ ফসলী সন, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) ইতিহাস
১৯১৮ সালের আগস্ট মাসে পবিত্র মক্কার শরীফের কাছ থেকে তাকে আত্মসমর্পণ করা মর্মে বার্তা এলে তিনি এ শব্দে জবাব দিয়েছিলেন-
‘ফখরী পাশার তরফ থেকে, যে উসমানী সেনাবাহিনীর সিপাহসালার এবং সর্বাধিক পবিত্র শহর মদীনা শরীফের রক্ষক এবং হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ক্ষুদ্র গোলাম।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ পাক উনার নামে, যিনি সর্বত্র বিরাজমান। আমি কি সেই ব্যক্তির কাছে অস্ত্র সমর্পণ করবো, যে ইসলামের শক্তি ভেঙে দিয়েছে? মুসলমানদের মধ্যে রক্ত ঝরিয়েছে এবং আমীরুল মু’মিনীনের খেলাফতের ওপর আশঙ্কার চিহ্ন একেঁ দিয়েছে? এবং ব্রিটিশদের কাছে নিজেকে বশীভূত করেছে?
জুমার রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি ক্লান্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছি। এই চিন্তায় যে, কিভাবে মদীনা শরীফের এই শহরকে রক্ষা করবো। হঠাৎ আমি এক জায়গায় নিজেকে অজানা লোকদের মধ্যে পাই, যারা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তখন আমি তাদের মধ্যে একজন বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্বকে দেখলাম, তিনি ছিলেন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। উনার প্রতি আল্লাহ পাক রহমত বর্ষণ করুন। তিনি উনার বাম হাত মুবারক আমার পিঠে রাখলেন এবং আমাকে নিরাপত্তার আশ্বাসে বললেন, “আমার সাথে এসো।” আমি উনার সাথে তিন-চার কদম হাঁটলাম এবং তারপর ঘুম থেকে জেগে উঠলাম।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে নববী শরীফে গেলাম এবং নবীজির রওজা মুবারকের সমীপে আমার রবের সামনে সিজদায় পড়ে গেলাম এবং এখন আমি অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছি। কারণ আমি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আশ্রয়ে রয়েছি। যিনি আমার সেনাপতি। আমি মদীনা শরীফ উনার ভবন-ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট এবং সীমানা রক্ষায় মনেপ্রাণে নিয়োজিত আছি। এখন আমাকে এসব ফালতু প্রস্তাব দিয়ে বিরক্ত করবে না।”
৩০ অক্টোবর, ১৯১৮ তারিখে উসমানী খেলাফত ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং উসমানী খেলাফতের যুদ্ধমন্ত্রী ফখরী পাশাকে একটি বার্তা পাঠায় যে, আমরা চুক্তি করে আত্মসমর্পণ করেছি। এখন আপনিও আত্মসমর্পণ করুন, কিন্তু ফখরি পাশা তা অমান্য করেন এবং নিজের তলোয়ার হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় উসমানীরা উনাকে পদ থেকে বরখাস্ত করে; কিন্তু তিনি অবিচল থেকে লড়াই চালিয়ে যান। ৫০ হাজার সেনার বিপরীতে মাত্র ১১ হাজার সেনা নিয়ে ৭২ দিন পবিত্র মদীনা শরীফের পতাকা সমুন্নত রাখেন ফখরুদ্দীন পাশা। এইভাবে যুদ্ধের অবসান হওয়া সত্ত্বেও এই ‘মরুভূমির চিতা’, আশেকে রসূল তিনি টানা ৭২ দিন একাকী আরব বিদ্রোহী, ব্রিটেন এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং মদীনা শহরকে উনার ক্ষুদ্র দল দ্বারা রক্ষা করতে থাকেন। অবশেষে উনার নিজের সঙ্গীরাই এক পর্যায়ে উনাকে ধরে শত্রুদের হাতে তুলে দেয়।
এভাবে ১৯১৯ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মক্কা শরীফের অধিবাসী আলী ও আবদুল্লাহ তারা পবিত্র মদীনা শহরে প্রবেশ করে এবং ১২ দিন পর্যন্ত নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শহর মুবারকে লুটপাট চালায়। ৪৮৫০টি বাড়ি-ঘর ভেঙে লুট করা হয় যেগুলো ফখরুদ্দীন তালা লাগিয়েছিলেন।
ফখরুদ্দীনকে মাল্টার কারাগারে ২ বছর বন্দি রাখা হয়। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক উনার ইচ্ছা ছিলো অন্যরকম। যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলামের জন্য প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও লড়াই চালিয়ে যায়, মহান আল্লাহ পাক তিনি তাকে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গাতেই সম্মানিত করেন।
দুই বছর কারাবরণ করার পরই ফখরুদ্দীন পাশা মুক্তি পান। কট্টর সেক্যুলার কামাল আতাতুর্ক উনার ইসলামপন্থী মনোভাব জানার পরও মদীনা শরীফে বীরত্বের কারণে মুক্তির পর উনাকে গ্রিস ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীতে নিয়ে নেয়। ১৯২১ সালে মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি তুরস্কের সেনাবাহিনীতে পুনরায় যোগদান করেন এবং গ্রিস এবং ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
এরপর সরকার প্রতিষ্ঠার পর তুরস্ককে ইসলাম থেকে দূরে রাখার অংশ হিসেবে ফখরুদ্দীন পাশাকে আফগানিস্তানের কাবুলে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দেয়া হয়, কিন্তু উনার প্রতি কোন প্রকার অসম্মান দেখানো হয়নি।
১৯৪৮ সালের ২২ নভেম্বর তিনি হার্ট অ্যাটাক করে ইন্তেকাল করেন। উনার অন্তিম ইচ্ছানুসারে উনাকে ইস্তাম্বুলে দাফন করা হয়।
মুসলমানদের জন্য বড়ই আফসুসের বিষয় যে, মুসলমানদের নতুন প্রজন্ম এই বীরের নামটুকু অবধি জানে না।
একটি সুচিন্তিত ষড়যন্ত্রের অধীনে মুসলমানদেরকে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অর্থহীন ফিল্ম-নাটকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। যাতে মুসলমানরা তাদের বীরদের এসব ঈমান জাগানিয়া অবদান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকে এবং যাতে তাদের মধ্যে সেই সাহসী মনোভাব ঈমানী কুওওয়াত জাগ্রত না হয়।
এখন সময় এসেছে এ সকল মহান বীরদের জীবনী পুনর্পাঠের, যারা মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন। আমাদের শিশুদেরকে এধরনের ঘটনা দ্বারা উপদেশ প্রদান করতে হবে, যাতে ইসলামের শত্রুরা আবারও নয়া যামানার ফখরুদ্দীন পাশার মুখোমুখি হতে পারে। (সমাপ্ত)
-০-
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কেমন ছিলো মোঘল সালতানাতের গোলন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
পান্থনিবাস ও সরাইখানা নির্মাণে মুসলমানদের অনবদ্য অবদান
২৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৯)
১৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার বিরোধিতায় বিধর্মী-অমুসলিমরা
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার হিন্দু ধনিক-বণিক, বেনিয়া শ্রেণী, ব্যাংকার প্রভৃতির সাথে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইউরোপকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন আফ্রিকান মুসলমানরা
১২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
গুজরাটের সুলতান মুজাফফর শাহের পরহেজগারিতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ
০২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৭)
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
কেমন ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ঐতিহাসিক মুসলিমবাগ ঈদগাহ-ই কি আজকের ঢাকেশ্বরী মন্দির?
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
১২টি চন্দ্রমাসের নাম এবং নামকরণের সার্থকতা (২)
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ঐতিহাসিক খেমকারান যুদ্ধ: যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের উদ্ভব
২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)












