ধানক্ষেত ছিলো, এক বিঘা জমির দাম ছিলো ৫ হাজার টাকা- ধানমন্ডি যেন গল্পগাথাকেও হার মানায়!
, ০৩রা রবিউছ ছানী শরীফ, ১৪৪৭ হিজরী সন, ২৮ রবি’, ১৩৯৩ শামসী সন , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রি:, ১২ আশ্বিন, ১৪৩২ ফসলী সন, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) পাঁচ মিশালী
ব্রিটিশ আমলে ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ছিলো ওয়ারি। পাকিস্তান আমলে তৈরি হয় ধানমন্ডি। এর আগে জায়গাটি পরিচিত ছিলো ‘ধানমন্ডাইয়ের মাঠ’ নামে।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ঢাকার স্মৃতি-৩ বই থেকে জানা যায়, ধানমন্ডাইয়ের মাঠ ছিলো ধু ধু মাঠ। মাঠ ঘিরে ছিলো ফুটবল ক্লাব। কলকাতা থেকে ফুটবল দল এলে এখানে বড় আসরের আয়োজন করা হতো।
দেশভাগের পর সি অ্যান্ড বি অধিগ্রহণ করে ধানমন্ডাই মাঠের প্রায় ৫০০ একর জমি। ঐতিহাসিকদের মতে, ‘ধানমন্ডাই’ নাম থেকেই ধানমন্ডি নামটি এসেছে। ধানমন্ডাই মানে ধানের আড়ৎ। প্রবীণরা বলেন, একসময় এখানে ধানের ক্ষেতও ছিলো।
ধানমন্ডি ছয় নম্বর রোডের বাসিন্দা সৈয়দ সালাউদ্দিন হুসাইন জানান, “ষাটের দশকের শেষ দিকেও ধান ক্ষেত দেখা যেতো। তখনকার বাড়িগুলো ছিলো একতলা বা দোতলা। প্রত্যেক বাড়িতেই ছিলো অনেক গাছ, বিশেষ করে নারকেল। কিন্তু এখন সেই বাড়িগুলোর বেশিরভাগই বহুতল ভবনে রূপ নিয়েছে”।
পুরোনো দিনের আবহ এখনও টিকে আছে অল্প কিছু বাড়িতে। এর একটি ধানমন্ডির ১৫/এ রোডের ‘তরুছায়া’। ১৯৮৬ সালে বাড়িটি তৈরি হয়। মালিক ছিলেন এক মনোবিজ্ঞানী।
তখনকার প্রায় সব বাড়িরই নাম গাছ বা প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলো-তরুপল্লব, ছায়াবীথি, আরণ্যক। তরুছায়ায় এখনো আছে বড় একটি নিমগাছ, কয়েকটি আমগাছ আর নারকেল গাছ। নব্বই দশক পর্যন্তও ধানমন্ডি ছিলো ঢাকার প্রধান অভিজাত এলাকা।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি ডিআইটি (ঢাকা ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট, এখনকার রাজউক) ধানমন্ডিতে এক বিঘা করে প্লট ভাগ ও বরাদ্দ শুরু করে। তখন ধানমন্ডি ছিলো ঢাকার উপান্তের এক গ্রাম। ফলে আকর্ষণ ছিলো কম। ডিআইটি তাই সরকারি কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করলো।
প্রথমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে চেষ্টা করলো, পরে প্রয়োজনে চাপও দিলো। অথচ এক বিঘা জমির দাম ধরা হয়েছিলো মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। কর্মকর্তারা টাকাটা জমা দিয়ে বাড়ি ফিরে দু’দিন মন খারাপ করে বসে থাকতেন। আত্মীয়-স্বজনদের বলতেন, “টাকাগুলো পানিতে ফেলে দিয়ে এলাম। ”
স্থানীয় প্রবীণ কামাল আহমেদ বললেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ধানমন্ডির বড়জোর ৩০ শতাংশ বাড়ি গড়ে উঠেছিলো, বাকিগুলো স্বাধীনতার পর। স্বাধীনতার পূর্বে ধানমন্ডির বাসিন্দারা বাজার করতেন নিউমার্কেটে, আশপাশে বাজার বলতে কিছুই ছিলো না। রায়েরবাজারে নদীর মাছ পাওয়া যেতো, কিন্তু তাতে সব চাহিদা মিটতো না।
সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘নিউমার্কেটটি উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকে শুরু হয় ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার নির্মাণ, সম্প্রসারণ ও বিক্রয়। আজকের তুলনায় এক অবিশ্বাস্য কম মূল্যে ধানমন্ডির প্লটগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো তখন। ’
নিউমার্কেট মূলত তৈরি হয়েছিলো ধানমন্ডি ও আজিমপুরের বাসিন্দাদের জন্য। ১৯৫৪ সালে এর উদ্বোধন হয়। তখন অনেকেই বলাবলি করতো- এটি নূরুল আমিনের পারিবারিক মার্কেট। সে সময় এটি ছিলো অভিজাতদের কেন্দ্র। এর সমকক্ষ আর কোনো মার্কেট ঢাকায় ছিলো না।
পাকিস্তান আমলে ঢাকায় ছিলো বিদেশি ডেপুটি হাইকমিশনের অফিস। স্বাধীনতার পর এগুলো পূর্ণাঙ্গ হাইকমিশন বা দূতাবাসে পরিণত হয়। এদের অনেকগুলোর অবস্থানই ছিলো ধানমন্ডিতে-ভুটানি, নেপালি, সুইডিশসহ নানা মিশন।
ধানমন্ডাই মাঠকে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে বেছে নেওয়ার পেছনে লেকের অবদান ছিলো অনেক। এটি মূলত কারওয়ান বাজার নদীর একটি পরিত্যক্ত খাল। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, এটি বেগুনবাড়ি খাল হয়ে গ্রিন রোড, কলাবাগান, ধানমন্ডি লেক ঘুরে তুরাগ নদীতে মিশতো।
পুরো ধানমন্ডির ১৬ ভাগ জুড়ে রয়েছে লেক। দৈর্ঘ্যে তিন কিলোমিটার, প্রস্থ ৩৫ থেকে ১০০ মিটার। ভেতরে তিনটি দ্বীপ, আর যান চলাচলের জন্য দুটি ব্রিজ আছে। সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি লেক পয়ঃনিস্কাশনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
লেক ঘিরে নানা আনন্দঘন কর্মকা- ছিলো। সমবয়সীদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হতো- কে বেশি মাছ ধরতে পারে। বিকেলে পরিবার নিয়ে নৌভ্রমণও ছিলো ধানমন্ডিবাসীর বড় বিনোদন।
২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে অনুষ্ঠিত হয় পুরোনো ধানমন্ডি নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী।
প্রদর্শনীতে স্থান পায় পনেরটি আলোকচিত্র। রজার গোয়েন, শহীদুল আলম, ডন ম্যাটসন, আলাউদ্দিন আহমেদ, রশীদ তালুকদার প্রমুখের তোলা ছবি সাজানো হয় সেখানে। ষাট ও সত্তরের দশকের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছবি তুলেছিলো ডন ম্যাটসন।
বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভে রয়েছে তার ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সালের বেশ কিছু ছবি। বিশেষ করে সদরঘাট, ধানমন্ডি ও কাকরাইল চার্চ এলাকার ছবি সময়ের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৬৭ সালে ধানমন্ডি লেকের পারে তোলা এক ছবিতে দেখা যায় কয়েকটি দোতলা বাংলো। সেসময় আবাহনী মাঠ ছিলো ইটভাটা, ছবিটি তার প্রমাণ বহন করে। ফ্রেমের এক পাশে ধরা পড়েছে একটি পানির ট্যাংকি- যেটি আজও টিকে আছে।
ধানমন্ডির চার নম্বর সড়কে সফিউদ্দিন আহমেদের পুরোনো বাড়িতে ছিলো প্রদর্শনশালা ‘গ্যালারি চিত্রক’। এখনো গ্যালারিটি আছে, তবে আগের মতো বাড়িটি আর নেই। সেখানে উঠেছে বহুতল ভবন, তারই কিছু অংশে টিকে আছে গ্যালারি চিত্রক।
ধানমন্ডির সবচেয়ে পরিচিত বাড়ি ছিলো ৩২ নম্বরের শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ছিলো বাড়িটি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে এটি ভেঙ্গে ফেলা হয়।
তবে ধানমন্ডির গল্প আরও পুরোনো। ফিরে যেতে হবে শাহ সুজা ও শায়েস্তা খাঁর আমলে। ১৬৪০ সালের দিকে বাংলার সুবেদার ছিলেন শাসক শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা। তার দেওয়ান মীর আবুল কাসিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো একটি বিশাল ঈদগাহ নির্মাণের, যেখানে মোঘলরা একত্রিত হয়ে নামাজ আদায় করবেন। এজন্য তিনি মূল শহরের ভিড়ের বাইরে যে বিস্তীর্ণ ও নিরিবিলি জায়গা বেছে নেন, সেটিই আজকের ধানমন্ডি। গবেষকদের মতে, এ ঈদগাহকে কেন্দ্র করেই তখন অনেক মোঘল আমীর-ওমরাদের বসতি গড়ে ওঠে এখানে।
ধানমন্ডিতেই নির্মিত হয় আরেকটি অনন্য স্থাপত্য-সাত গম্বুজ মসজিদ। ধারণা করা হয়, ১৬৮০ সালের দিকে শায়েস্তা খান এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। তবে কেউ কেউ বলেন, তার পুত্র উমিদ খাঁ মসজিদটি গড়ে তোলেন। মোঘলদের ধর্মীয় সমাবেশ ও এসব স্থাপত্যকীর্তিই ধানমন্ডিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছিলো।
কালের আবর্তনে ধানমন্ডির চেহারা পাল্টে গেছে। মোঘল আমলের স্থাপত্য ও পঞ্চাশের দশকের পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা-সবকিছু পেরিয়ে এখন ধানমন্ডি ভরপুর বহুতল ভবনে। সাত মসজিদ রোডে অসংখ্য খাবারের দোকান, রাস্তায় ঘন যানজট। সত্তর ও আশির দশকের ধানমন্ডি দেখা মানুষজন সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন। তবু মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ বলে ওঠেন, “আহা! কি সব দিন ছিলো। ”
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
সরকারি ছুটি নির্ধারণ হয় কিভাবে, সব ছুটি কি সবাই পায়?
১২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
শীতকালে স্ট্রবেরি খাওয়ার উপকারিতা
১২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
এক হাতঘড়ি বিক্রি হলো ২১৫ কোটি ৭১ লাখ টাকায়!
১১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
সমুদ্রের তলদেশের আশ্চর্য্য প্রাণী
১১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
কীভাবে এলো রক্তের গ্রুপ?
১০ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত ৫ মাছ, খেলে নিশ্চিত মৃত্যু
০৯ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
হারিয়ে যাচ্ছে আভিজাত্যের ঘোড়ার গাড়ি
০৯ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
পাকিস্তানে ৬৩৬ বিলিয়ন ডলারের স্বর্ণভান্ডার আবিষ্কার
০৯ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
সিঙ্গাপুরের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য ‘মারূফ মসজিদ’
০৯ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে ডাক প্লেগের ভ্যাকসিন সিড হস্তান্তর করলো বাকৃবি
০৭ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
টাইটানে পানি ও তেল একসঙ্গে মিশছে!
০৭ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
দুপুরে খাওয়ার পরপরই খাবেন না এই তিন খাবার
০৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার)












