রোযার দুই মাস আগেই বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম
-তেল-চিনির দাম আগে বেড়েছে, এখন বাড়ছে ছোলা-ডালের
এডমিন, ১১ই রজবুল হারাম শরীফ, ১৪৪৪ হিজরী সন, ০৫ তাসি, ১৩৯০ শামসী সন, ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ খ্রি:, ২০ই মাঘ, ১৪২৯ ফসলী সন, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) তাজা খবর

নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রতি বছর রোযার মাসে বেশি চাহিদা থাকে তেল, চিনি, ছোলা, আদা, ডাল, খেজুর প্রভৃতি পণ্যের। রমাদ্বান শরীফ মাস শুরুর বাকি এখনো প্রায় দুই মাস। অথচ এরই মধ্যে এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অন্য নিত্যপণ্যের দামেও ঊর্ধ্বগতি। উদ্বেগ বাড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানির দাম, ডলার ও এলসি সংকটে দাম বাড়ানো ছাড়া তাদের উপায় নেই।
বাজার পরিস্থিতি যাই হোক, এবারও রমাদ্বান শরীফে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মহল। কিন্তু রমাদ্বান শরীফ শুরুর আগেই দ্রব্যমূল্যের আগাম ঊর্ধ্বগতির কারণে এমন আশ্বাসে ভরসা নেই জনগণের। তারা বলছেন, বিগত কয়েক বছরের মতো এ রমাদ্বান শরীফেও অসৎ ব্যবসায়ী চক্র পুরোনো ছকে চলছে। রমাদ্বান শরীফ নির্ভর পণ্যের দাম তারা আগেই বাড়াতে শুরু করেছে, যাতে রমাদ্বান শরীফে নতুন করে বাড়ানোর প্রয়োজন না পড়ে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, বৈশ্বিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, ডলার সংকটে এলসি খোলায় সমস্যার কারণে সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। বাধ্য হয়ে তারা পণ্যমূল্য সমন্বয় করছেন। অস্বাভাবিকভাবে কোনো পণ্যের মূল্য বাড়ছে না।
রামপুরা জামতলা এলাকার ফরিদা ইয়াসমিন অনেক হিসাব করে সংসার চালান। গত মঙ্গলবার (৩১ জানুয়ারি) তিনি রমাদ্বান শরীফের কিছু পণ্য আগাম কিনে রাখার জন্য বাজারে গিয়েছিলেন, যাতে সে সময় সংসারে বাড়তি চাপ না পড়েন। তিনি বলেন, প্রতি রমাদ্বান শরীফে পণ্য কিনতে হিমশিম খেতে হয়। সেজন্য এবার গত বছরের অর্জিত ছুটির কিছু টাকা দিয়ে বাজার সেরে রাখতে চেয়েছিলাম। এসে দেখি রোযার জন্য আমার যা যা প্রয়োজন, সবকিছুর দাম বেশি।
তিনি বলেন, তেল, চিনি, আদা, রসুন, ছোলা, ডাল, খেজুরসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। বেসনের দামও বেশি। কিন্তু রোজার জন্য প্রয়োজন নয়, এমন পণ্যের দাম কিন্তু বাড়ছে না। তাহলে এটাকে সিন্ডিকেট ছাড়া কী বলা যায়? প্রতি বছর একই ছক এঁকে ভোক্তার পকেট কাটা হচ্ছে।
রমাদ্বান শরীফের পণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিক্রেতারাও। খিলগাঁও রেলগেট বাজারে নোয়াখালী স্টোরের স্বত্বাধিকারী ফারুক খান বলেন, মুদিপণ্য যেগুলো রমাদ্বান শরীফে বেশি লাগে, সবকিছুর দামই এখন বেশি। শুধু তাই নয়, চিনি, তেলের মতো পণ্যগুলোর সরবরাহ সংকটের কথাও শোনা যাচ্ছে ইদানীং। ওই সময় পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটা জানা নেই। তবে বাজার স্থিতিশীল থাকবে না সেটা নিশ্চিত।
রমাদ্বান শরীফে খেজুরসহ বেশকিছু ফলের চাহিদাও বাড়ে। কারওয়ান বাজারে ফল বিক্রেতা খালেক মন্ডল বলেন, খেজুরের দাম আরও দুই মাস আগে থেকে বাড়ছে। পাইকারি বাজারে অনেকে মজুত রাখছে। ছাড়ছে না। সে কারণে খুচরায় আগের তুলনায় প্রতি কেজি খেজুর মানভেদে ২০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
তেল-চিনির দাম আগে বেড়েছে, এখন বাড়ছে ছোলা-ডালের:
বাজারে দীর্ঘদিন ধরে তেল, চিনির দাম বাড়তি। গত সপ্তাহে চিনির দাম আরেক দফা কেজিতে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে প্রতি কেজি পরিশোধিত চিনির দাম (খোলা) পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ১০৭ এবং পরিশোধিত চিনির (প্যাকেটজাত) দাম চার টাকা বাড়িয়ে ১১২ টাকা করা হয়েছে। যদিও বাজারে সেই দামেও চিনি মিলছে না। কিনতে হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা কেজিতে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ- টিসিবির তথ্য বলছে, গত বছরের তুলনায় এখন চিনির দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে। আর সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ। পাম তেলের দাম বেড়েছে ১৮ শতাংশ। বছরের ব্যবধানে এখন মসুর ডালের দাম ১৭ শতাংশ ও ছোলার দাম ১৩ শতাংশ বেশি।
এছাড়া এসময় পেঁয়াজের দাম না বাড়লেও গত বছরের একই সময়ে দেশে আদার দাম মানভেদে ৫০-১১০ শতাংশ, রসুনের দাম ৪৫-১২৭ শতাংশ এবং শুকনো মরিচের দাম ৭৫-১৫২ শতাংশ কম ছিল। খেজুরের দাম শতাংশে হিসাব না করে দেখালেও সংস্থাটি বলছে, কেজিতে ২০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেন, আমাদের কিছু আমদানির সমস্যা হচ্ছে। তবে সেটা পুঁজি করে বাজারে তারচেয়েও বেশি অস্থিরতা তৈরির প্রচেষ্টা রয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
‘কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা রমাদ্বান শরীফে পণ্যের দাম খুব কম বাড়ান। রমাদ্বান শরীফ আসার এক-দুই মাস আগেই দাম বাড়িয়ে দেন। বর্তমান বাজারে সবকিছুই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। তাই রমাদ্বান শরীফ আসার আগেই এ বিষয়টি নিয়ে কঠোর মনিটরিং করে সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নিতে হবে। অযৌক্তিক মুনাফার লোভে সময়-সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে আসছে। সেগুলোর কঠিন মনিটরিং প্রয়োজন।’
যা বলছেন বড় ব্যবসায়ীরা:
রমাদ্বান শরীফে একটি পরিবারের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় তেল, চিনি, ছোলা, ডাল, খেজুরের মতো পণ্যগুলো। যেগুলোর সবকটি পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছেন না। আমদানি করা পণ্যও খালাস করতে পারছেন না ডলারের অভাবে। এর মধ্যে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচও বেড়েছে। তাই রমাদ্বান শরীফে ভোগ্যপণ্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, বাজারে সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ব্যবসায়ীদের সহায়তা দিতে হবে। কিন্তু এখন আমরা অনেক সংকটে। এর মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। সেগুলোও সমস্যা।
তিনি বলেন, আমদানি সংকট রয়েছে। অনেক সময় এলসি খোলা যাচ্ছে না। এলসি খুলে পণ্য বন্দর পর্যন্ত এনেও কোনো কোনো ব্যবসায়ী ডলার না থাকার কারণে বিল পরিশোধ করতে পারছেন না। কাঁচামাল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্য একটি শিল্প গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি কোম্পানি সেটুকু উৎপাদন করছে, যেটুকু দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া যায়। পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ। যাদের অবস্থা ভালো, তারা কেউ ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। আর অধিকাংশের সামর্থ্য নেই।