পবিত্র কুরআন শরীফে বর্ণিত ‘লাইলাতুম মুবারকা’ই হচ্ছে পবিত্র শবে বরাত (৪)
, ৯ই শা’বান শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ১২ তাসি’, ১৩৯২ শামসী সন , ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রি:, ২৬ মাঘ, ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) পবিত্র দ্বীন শিক্ষা
পবিত্র কুরআন শরীফে বর্ণিত اَنْزَلَ ও نَزَّلَ শব্দদয় উনাদের পার্থক্য:
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
হযরত ইমাম রাগিব ইস্পাহানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-
اَلْفَرْقُ بَيْنَ الْاِنْزَالِ وَالتَّنْزِيْلِ فِىْ وَصْفِ الْقُرْاٰنِ وَالْمَلَائِكَةِ اَنَّ التَّنْزِيْلَ يَخْتَصُّ بِالْمَوْضِعِ اَلَّذِىْ يَشِيْرُ اِلٰى اِنْزَالِهِ مُتَفَرِّقًا وَمَرَّةً بَعْدَ اُخْرٰى وَالْاِنْزَالُ اَعَمُّ مِنْ ذٰلِكَ وَمِنْهُ قَوْلُه تَعَالٰى {اِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ}
অর্থ: “মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কুরআন শরীফ এবং হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের বৈশিষ্ট বর্ণনা করার ক্ষেত্রে اَلْاِنْزَالُ ও اَلتَّنْزِيْلَ শব্দ মুবারক উনাদের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- اَلتَّنْزِيْلَ শব্দ মুবারক ঐ স্থানের জন্য খাছ। যেখানে পৃথকভাবে কোনো কিছু নাযিল হওয়ার ইঙ্গিত করা হয় এবং যা বারবার নাযিল হয়। আর اَلْاِنْزَالُ শব্দ মুবারক এর থেকে আম বা ব্যাপক অর্থবোধক। যেমন: মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, নিশ্চয়ই আমি পবিত্র শবে ক্বদরে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কুরআন শরীফ (একত্রে) নাযিল করেছি। ” (ফাতহুল বারী ১৩/ ৪৬৩, ইরশাদুস সারী লি শারহে ছহীহিল বুখারী ১০/৪৩৩, ফাতহুস সালাম শরহে উমদাতুল আহকাম ৭/৪৮০ ইত্যাদি)
উক্ত কিতাবে আরো বর্ণিত রয়েছে-
وَيُؤَيِّدُ التَّفْصِيْلَ بِقَوْلِهِ تَعَالٰى {يٰاَيُّهَا الَّذِينَ اٰمَنُوْا اٰمِنُوْا بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ وَالْكِتٰبِ الَّذِىْ نَزَّلَ عَلٰى رَسُوْلِهِ وَالْكِتٰبِ الَّذِىْ اَنْزَلَ مِنْ قَبْلُ} [النساء: ১৩৬] فَاِنَّ الْمُرَادَ بِالْكِتَابِ الْاَوَّلِ الْقُرْاٰنُ وَبِالثَّانِىْ مَا عَدَاهُ وَالْقُرْاٰنُ نَزَلَ نُجُوْمًا اِلَى الْاَرْضِ بِحَسَبِ الْوَقَائِعِ بِخِلَافِ غَيْرِهِ مِنَ الْكُتُبِ
অর্থ: উপরোক্ত ব্যাখ্যাটা আরো সুদৃঢ় করা হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম মুবারক- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি, উনার মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র হাবীব মাহবূব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি, সম্মানিত কিতাব যা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি নাযিল করা হয়েছে, আর উনার পূর্বে যে সমস্ত কিতাবসমূহ নাযিল করা হয়েছে উনাদের প্রতি পরিপূর্ণভাবে সম্মানিত ঈমান মুবারক আনো। ’ উনার দ্বারা। (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১৩৬)
এই পবিত্র আয়াত শরীফে প্রথম কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কুরআন শরীফ। আর দ্বিতীয় কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, পূর্ববর্তী নাযিলকৃত আসমানী কিতাবসমূহ। মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র কুরআন শরীফ বিভিন্ন ঘটনা মুবারক সংঘটিত হওয়ার পেক্ষাপটে ধাপে ধাপে যমীনে নাযিল হয়েছে। যা পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহ (তাওরাত শরীফ, যাবূর শরীফ, ইঞ্জীল শরীফ) থেকে ভিন্ন। (কেননা পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহ একত্রে নাযিল করা হয়েছে। ) (ফাতহুল বারী ১৩/৪৬৪, ইরশাদুস সারী লি শারহে ছহীহিল বুখারী ১০/৪৩৩, ফাতহুস সালাম শরহে উমদাতুল আহকাম ৭/৪৮০ ইত্যাদি)
উল্লেখিত আলোচনা থেকে اَنْزَلَ ও نَزَّلَ শব্দদ্বয় উনাদের পার্থক্য স্পষ্টভাইে বুঝা গেলো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে কখন থেকে পবিত্র কুরআন শরীফ নাযিল হওয়া শুরু হয়েছে?
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে, হযরত আনাস বিন মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন-
بَعَثَهُ اللهُ تَعَالٰى عَلٰى رَأْسِ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً
অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে উনার দুনিয়াবী হায়াত মুবারক যখন ৪০ বছর তখন সম্মানিত রিসালত ও নুবুওওয়াত মুবারক হাদিয়া করেছেন। অর্থাৎ উনার সম্মানিত রিসালতী ও নুবুওওয়াতী শান মুবারক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছেন দুনিয়াবী ৪০ বছর হায়াত মুবারকে। সুবহানাল্লাহ! (শামায়েলে তিরমিযী)
উল্লেখিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে হাজার আসক্বালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, এই বর্ণনাটি সেই মতকে সমর্থন করে, যাতে বলা হয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সেই সম্মানিত মাস মুবারকেই সম্মানিত নুবুওওয়াত মুবারক হাদিয়া করা হয়েছে, যেই সম্মানিত মাস মুবারকে তিনি মহাসম্মানিত বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশ করেছেন। সুবহানাল্লাহ!
তবে জমহুর উলামায়ে কিরাম উনাদের নিকট প্রসিদ্ধ হলো, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সাইয়্যিদুশ শুহূর মহাসম্মানিত রবীউল আউওয়াল শরীফ মাসে বিলাদত শরীফ গ্রহণ করেছেন এবং পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাসে উনার সম্মানিত নুবুওওয়াতী শান মুবারক প্রকাশ করেছেন। এ মত অনুযায়ী সম্মানিত নুবুওওয়াত মুবারক প্রকাশের সময় নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দুনিয়াবী হায়াত মুবারক হবে ৪০ বছর ছয় মাস অথবা ৩৯ বছর ছয় মাস। সুতরাং যারা ৪০ বছর বলেছেন, উনারা কেউ ছয় মাস বাদ দিয়ে বলেছেন অথবা ছয় মাস যুক্ত করে বলেছেন। (যাতে পূর্ণ ৪০ বছর হয় না। )
কিন্তু হযরত মাসঊদী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত ইবনে আবদিল বার রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা বলেছেন-
إِنَّه بُعِثَ فِيْ شَهْرِ رَبِيْعِ الْأَوَّلِ فَعَلٰى هٰذَا يَكُوْنُ لَه أَرْبَعُوْنَ سَنَةً سَوَاء
অর্থ: নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত নুবুওওয়াত ও রিসালত মুবারক সাইয়্যিদুশ শুহূর মহাসম্মানিত রবীউল আউয়াল শরীফ মাসে প্রকাশিত হয়েছেন। এ মত অনুযায়ী বরাবর ৪০ বছরই পূর্ণ হয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ! (ফাতহুল বারী ৬/৫৭০)
উল্লেখ্য, পবিত্র কুরআন শরীফ নাযিলের মাধ্যমেই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত নুবুওওয়াতী ও রিসালতী শান মুবারক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিলেন। আর সেটা ছিলেন সাইয়্যিদুশ শুহূর মহাসম্মানিত রবীউল আউওয়াল শরীফ মাস উনার সাইয়্যিদু সায়্যিদিল আ’দাদ শরীফ অর্থাৎ মহাসম্মানিত ১২ই রবীউল আউওয়াল শরীফ। ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম শরীফ অর্থাৎ সোমবার। সুবহানাল্লাহ! যা উল্লেখিত আলোচনায় সুস্পষ্ট।
কাজেই পবিত্র কুরআন শরীফ নাযিল হওয়ার ধারাবাহিকতা হচ্ছে-
১. পবিত্র শবে বরাতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে,
২. পবিত্র শবে ক্বদরে লাওহে মাহফূয থেকে দুনিয়ার আসমানে বাইতুল ইয্যত শরীফ নামক হুজরা শরীফে পুরো পবিত্র কুরআন শরীফ একত্রে নাযিল করা হয়েছে,
৩. সেখান থেকে সাইয়্যিদুশ শুহূর মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র রবীউল আউওয়াল শরীফ উনার মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র সাইয়্যিদু সাইয়্যিদিল আ’দাদ শরীফে (১২ই শরীফে) ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম শরীফ (সোমবার) নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে পবিত্র কুরআন শরীফ নাযিল হওয়া শুরু হয়েছে। সুবহানাল্লাহ!
সুতরাং, উপরোক্ত দলীলভিত্তিক আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, পবিত্র সূরা দুখান শরীফে বর্ণিত ‘লাইলাতুম মুবারকা’ই হচ্ছেন পবিত্র শবে বরাত, পবিত্র শবে ক্বদর নয়। এই রাত মুবারক হচ্ছেন ফায়ছালা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের রাত, এই রাত মুবারকে সমস্ত কিছু ফায়ছালা করা হয় আর সেটা পবিত্র শবে ক্বদরে জারী করা হয়। যারা বলে পবিত্র কুরআন শরীফে শবে বরাত নেই তাদের কথা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এটা তাদের জিহালতির বহিঃপ্রকাশ।
-হাফিয মুহম্মদ ইমামুল হুদা।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের দৃষ্টিতে রোযা অবস্থায়- ইনজেকশন, ইনহেলার, স্যালাইন ও টিকা নেয়া অবশ্যই রোযা ভঙ্গের কারণ (১২)
১৬ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ছবি তোলা হারাম ও নাজায়িয
১৬ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
১৬ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত বড়পীর ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাওয়ানেহ উমরী মুবারক (১১)
১৬ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
এই উপমহাদেশে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম ও মুসলমানদের ঈমান-আমলের ক্ষতিসাধনে দেওবন্দীদের কার্যক্রম এবং তাদের ভ্রান্ত ফতওয়া (৫)
১৬ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
‘গরুর গোস্তে রোগ আছে’ এই সংক্রান্ত বাতিল হাদীছ ও তার খন্ডনমূলক জবাব
১৬ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের দৃষ্টিতে রোযা অবস্থায়- ইনজেকশন, ইনহেলার, স্যালাইন ও টিকা নেয়া অবশ্যই রোযা ভঙ্গের কারণ (১১)
১৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
পর্দা পালন করা নারী-পুরুষ সকলের জন্যই শান্তি ও পবিত্রতা হাছিলের কারণ
১৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
১৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
তারা প্রত্যেকেই মূর্তিপূজারী ও মুশরিক হয়ে কাট্টা কাফির ও মুরতাদ হয়েছে (১৬)
১৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মসজিদে ইবাদত করতে বাধা দেয়া বা মসজিদ উচ্ছেদ করা কুফরী
১৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
কথিত স্বজন-পরিজন হলেও কাফিরদেরকে বন্ধু বা অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না
১৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)