হিজাব বা পর্দা ফরযে আইন হওয়ার প্রমাণ ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (পর্ব-৩১)
, ০৮ শাওওয়াল শরীফ, ১৪৪৪ হিজরী সন, ২৯ হাদি ‘আশির, ১৩৯০ শামসী সন , ২৯ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রি:, ১৬ বৈশাখ, ১৪৩০ ফসলী সন, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) মহিলাদের পাতা
যে সকল আয়াত শরীফসমূহ দ্বারা ‘হিজাব বা পর্দা’ ফরয প্রমাণিত হয়েছে তা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, শুধু বোরকা বা পর্দা করে রাস্তায় বের হওয়ার নাম হিজাব বা পর্দা নয়। বরং তার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট ও আয়াত শরীফসমূহে উল্লিখিত সকল হুকুম-আহকামসমূহ মেনে চলার নামই হচ্ছে “শরয়ী হিজাব বা পর্দা”।
যেমন, কারো ঘরে প্রবেশ করার পূর্বে অনুমতি নেয়া, মাহরাম ব্যতীত অন্য কারো সাথে দেখা-সাক্ষাত না করা, মাহরামদের সামনেও শালীনতা বজায় রাখা, গায়রে মাহরামদের সামনে চেহারা, হাত, পাসহ সমস্ত শরীর ঢেকে রাখা, চলাচলের সময় পুরুষ-মহিলা উভয়ের দৃষ্টিকেই অবনত রাখা, নিজেদের লজ্জাস্থানকে হিফাযত করা, বিনা প্রয়োজনে গলার আওয়াজ বা কণ্ঠস্বর পরপুরুষকে না শুনানো, প্রয়োজনে কথা বলতে হলে ও কিছু চাইতে হলে পর্দার আড়াল থেকে বলা ও চাওয়া এবং শক্ত ভাষায় কথা বলা, নরম ভাষায় কথা না বলা ইত্যাদি সবই হিজাব বা পর্দার অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ পাক তিনি উল্লেখিত আয়াত শরীফসমূহে এ বিষয়গুলিই মূলতঃ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন।
উল্লেখিত প্রতিটি বিষয়ে ‘তাফসীর বা ব্যাখ্যা’ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরলে বিষয়গুলো আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং শরয়ী ‘হিজাব বা পর্দার” পরিচয় সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে। তাই নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থ থেকে উল্লেখিত প্রতিটি বিষয়ের তাফসীর বা ব্যাখ্যা পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করা হলো-
হিজাব বা পর্দা সম্পর্কিত সূরা নূর শরীফ উনার ৩১নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার সঠিক তাফসীর বা ব্যাখ্যা-
ولايبدين زينتهن الا ما ظهر منها
অর্থ: “(আমার সম্মানিত হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি ঈমানদার নারীদেরকে বলুন) তারা যেন তাদের সৌর্ন্দয প্রদর্শন না করে। তবে চলাচলের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বে যা প্রকাশ পায় তা ব্যতীত।” (পবিত্র সূরা নূর শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৩১)
গাইরে মাহরামদের সামনে মহিলাদের মুখম-ল, হাত ও পা খোলা রাখা সম্পূর্ণ নাজায়িয ও হারাম অত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে زينة শব্দ দ্বারা মহিলাদের যাবতীয় সৌন্দর্য যেমন, মাথার মুকুট, কানের দুল, গলার হার বা মালা, হাতের আংটি, চুড়ি বা বালা, বাজু বন্ধ, পায়ের ঝুমুর বা নুপুর ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে। যার প্রদর্শন বা প্রকাশ হারাম বা নাজায়িয।
আর الا ما ظهر منها এর ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ ও সর্বজনমান্য তাফসীরগুলোতে কাপড়, চাদর, বোরকা ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মহিলাদের উপরের চাদর বা বোরকার উপর দৃষ্টি পড়লে মহিলাদের গুনাহ হবে না। তবে বেগানা পুরুষ কোন বেগানা মহিলার বোরকার উপরও ইচ্ছাকৃত দৃষ্টি দিতে পারবে না।
উক্ত আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ উনারা যে ফায়সালা দিয়েছেন তা হচ্ছে-“হযরত আব্দুর রাজ্জাক ফারইময়ানী, সাঈদ বিন মানছুর, ইবনু আবী শাইবাহ, আব্দুল্লাহ বিন হুমাইদ, ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযির, ইবনু আবী হাতিম, তাবারানী, হাকিম, ইবনু মারদুবিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহিম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের থেকে বর্ণনা করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম-
(ولا يبدين زيتهن) “তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে”-এর মধ্যে زينة ‘যীনাতুন’-এর তাফসীরে বলেন, তারা যেন প্রকাশ না করে হাতের চুড়ি বা বালা, বাজবন্ধ, পায়ের গহনা বা নুপুর-ঝুমুর, কানের দুল, গলার হার বা মালা ইত্যাদি। (الا ما ظهر منها) “তবে যা অনিচ্ছাসত্ত্বে প্রকাশ পায় তা ব্যতীত।” -এর তাফসীরে বলেন, কাপড় বা পোশাক এবং চাদর বা বোরকা ইত্যাদির বাহ্যিক প্রকাশ দোষণীয় নয়। (যা চুপানো সম্ভব নয়)” (তাফসীরে আদ দুররুল মানছুর ৪র্থ জিল্দ ৪১ পৃষ্ঠা)
“হযরত ইবনু আবী শাইবাহ, ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযির রহমতুল্লাহি আলাইহিম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, সৌন্দর্য দু’প্রকার। এক ‘যীনাতুয যাহিরাহ’ বাহ্যিক সৌন্দর্য, দুই. ‘যীনাতুন বাতিনাহ গুপ্ত সৌন্দর্য। এই গুপ্ত সৌন্দর্য আহাল বা স্বামী ছাড়া কেউ দেখবে না বা দেখা জায়িয হবে না। ‘যীনাতুয যাহিরাহ’ বা বাহ্যিক সৌন্দর্য হলো কাপড় বা পোশাক, বোরকা। ‘যীনাতুল বাতিনাহ’ বা গুপ্ত সৌন্দর্য হলো চোখের সুরমা, হাতের চুড়ি বা বালা এবং হাতের আংটি ইত্যাদি। হযরত ইবনে জারীর রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বক্তব্য এ রকম- বাহ্যিক সৌন্দর্য হলো কাপড় বা বোরকা আর চুপানো সৌন্দর্য হলো, দু’পায়ের গহনা, দু’কানের গহনা, দু’হাতের চুড়ি বা বালা।” (তাফসীরে আদ দুররুল মানছুর ৪র্থ জিল্দ ৪১ পৃষ্ঠা)
“(তারা যেন তাদের সৌন্দর্যকে প্রকাশ না করে।)” অর্থাৎ যে উপকরণ দ্বারা তারা সৌন্দর্য প্রকাশ করে যেমন, সাজসজ্জা, অলংকার এবং অনুরুপ অন্যান্য সৌর্ন্দয্যের জিনিস যেন তারা প্রকাশ না করে। (তবে চলাচলের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বে যা প্রকাশ পায় তা ব্যতীত) .... হযরত ইমাম তবারানী, হাকিম, ইবনুল মুনযির রহমতুল্লাহি আলাইহিম এবং অন্যান্যগণ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি যা প্রকাশে অসুবিধা নেই’-এর ব্যাখ্যায় কাপড় ও চাদর বা বোরকা চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু রিওয়ায়েতে কাপড় বা বোরকার কথাই বলা হয়েছে। এর উপর হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি একমত হয়েছেন। সৌর্ন্দযের এই অর্থ মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেছেন, (তোমরা প্রত্যেক নামাযের সময় আবরণ গ্রহণ করো।) এ রকম ‘বাহ্র’ নামক কিতাবেও আছে।” (তাফসীরে রূহুল মায়ানী ১০ জিল্দ ১৪০, ১৪১ পৃষ্ঠা, আল বাহর)
“মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম, (তারা যেন তাদের সৌন্দর্যকে প্রকাশ না করে।) অর্থাৎ তারা (মহিলারা) গাইরে মাহরামদের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। তাদের সৌন্দর্য দু’প্রকার।
এক চুপানো সৌন্দর্য। যেমন, দু’হাতের চুড়ি বা বালা, দু’কানের দুল, বাজু বন্ধ, গলার হার বা মালা এবং অনুরূপ অন্যান্য সৌন্দর্যের বস্তু। দুই বাহিরের সৌন্দর্য যার দিকে ইঙ্গিত করেছে মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম (الا ما ظهر منها তবে অনিচ্ছা সত্ত্বে যা প্রকাশ পায় তা ব্যতীত)। এ অংশটি। এ অংশের ব্যাখ্যায় ৭টি মত রয়েছে।
প্রথম মতটি হলো- অনিচ্ছা সত্ত্বেও যা প্রকাশ পায় তা হলো ‘কাপড় বা পোশাক।” হযরত আবূ আহওয়াছ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এটি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণনা করেছেন। অন্য রিওয়ায়েতে আছে, তিনি বলেছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বে প্রকাশমান সৌন্দর্য হলো উপরের চাদর বা বোরকা। .... হযরত কাযী আবূ ইয়া’লা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেছেন, প্রথম মতটিই গ্রহণযোগ্য ও প্রাধান্যপ্রাপ্ত। হযরত আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এ বিষয়ে দলীল প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, বাহ্যিক সৌন্দর্য হলো কাপড় বা বোরকা। “মহিলার শরীরের সবকিছুই আবরণীয় বা পর্দাযোগ্য। এমনকি হাতের নখও।” -এ দলীল এই ফায়দা দেয় যে, বিনা ওযরে বেগানা মহিলার যে কোন অঙ্গের দিকে দৃষ্টি দেয়া হারাম। ইচ্ছা করলে মহিলাকে বিবাহের পূর্বে পছন্দের জন্য এবং তার থেকে সাক্ষ্য নেয়ার সময় এ দু’অবস্থায় খাছভাবে শুধু চেহারা বা মুখম-ল দেখতে পারবে। কোন ওযর ছাড়াই মহিলার দিকে দৃষ্টি দেয়া নিষেধ। তাই মহিলার দিকে দৃষ্টি দেয়া জায়িয নেই। শাহওয়াত বা কুচিন্তার সাথে হোক, অথবা শাহওয়াত বা কুচিন্তা ছাড়া হোক। এ হুকুমের মধ্যে শরীরের মুখম-ল, হাত এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গ শামীল। অর্থাৎ মুখম-ল, হাত, পাসহ সমস্ত শরীর ঢেকে রাখা ফরযে আইন। যার প্রকাশ নাজায়িয ও হারাম।”
-০-
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য
০৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
খছম বা ঝগড়া কু-স্বভাবটি পরিহার করা অপরিহার্য কর্তব্য
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
যে ৪ শ্রেণীর লোকদের জন্য ক্বিয়ামতের দিন সুপারিশ ওয়াজিব হবে
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
মুসলমান পুরুষ ও মহিলা সকলের জন্যই ফরযে আইন হচ্ছে- যথাযথভাবে ৫ ওয়াক্ত নামায তারতীব অনুযায়ী যথাসময়ে আদায় করে নেয়া
০২ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
মহাসম্মানিত মহাপবিত্র হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা বেমেছাল ফযীলত মুবারকের অধিকারী
০২ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
হুব্বে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
০১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-
০১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সৃষ্টির শুরুতেই মহান আল্লাহ পাক উনার কুদরত মুবারক উনার মধ্যে ছিলেন, আছেন এবং অনন্তকাল থাকবেন
০১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
মহান আল্লাহ পাক তিনি তওবাকারীকে পছন্দ করেন (১)
৩০ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ক্বলবী যিকির জারী না থাকলে শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়
৩০ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য
২৭ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
সাইয়্যিদু সাইয়্যিদিল আ’ইয়াদ শরীফ মেহমানদারী করার মাধ্যমে উদযাপনে শাফায়াত মুবারক লাভ
২৭ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার)












