দ্বীনি তা’লীম:
পুরুষ ও মহিলাদের নামাযে পদ্ধতিগত পার্থক্য (৭)
, ০৭ যিলহজ্জ শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ০৫ আউওয়াল, ১৩৯৩ শামসী সন , ০৪ জুন, ২০২৫ খ্রি:, ২২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ ফসলী সন, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) মহিলাদের পাতা

গায়রে মুকাল্লিদ আলেমদের ফতওয়া:
মহিলাদের নামাযের পদ্ধতিতে ইতোপূর্বে যা কিছু উল্লেখ করা হলো তথা পবিত্র হাদীছ শরীফ, আছারে ছাহাবা, তাবেয়ীনদের ইজমা এবং চার ইমামের ঐক্যমতের আলোকে যুগ যুগ ধরে অবিচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরায় যেই পার্থক্যের আমল চলে আসছে, সেটাকে গায়রে মুকাল্লিদদের নেতৃস্থানীয় আলেমরাও স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সেই আলোকে ফতওয়া দিয়েছে।
# মাওলানা মুহম্মদ দাউদ গযনবী উনার পিতা আল্লামা আব্দুল জাব্বার গযনবীকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, “মহিলাদের নামাযে জড়সড় হয়ে থাকা কি উচিত?” জবাবে তিনি একটি হাদীছ শরীফ উল্লেখ করার পর লেখেন, “এর উপরই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের চার মাযহাব ও অন্যান্যের মাঝে আমল চলে আসছে”।
এরপর তিনি চার মাযহাবের কিতাবের উদ্ধৃতি প্রদান করার পর লিখেন, “মোটকথা মহিলাদের জড়সড় হয়ে নামায পড়ার বিষয়টি হাদীছ শরীফ ও চার মাযহাবের ইমামগণ ও অন্যান্যদের সর্বসম্মত আমলের আলোকে প্রমাণিত। এর অস্বীকারকারী হাদীছের কিতাবসমূহ ও মুসলিম উম্মতের সর্বসম্মত আমল সম্পর্কে বেখবর ও অজ্ঞ”। (ফতওয়ায়ে গযনবীয়াহ-২৭-২৮, ফতওয়ায়ে ওলামায়ে আহলে হাদীছ-৩/১৪৮-১৪৯, মাযমুয়ায়ে রাসায়েল- মাওলানা মুহম্মদ আমীন সফদর-১-৩১০-৩১১)
মাওলানা আলী মুহম্মদ সাঈদ “ফতওয়ায়ে ওলামায়ে আহলে হাদীছ”-এ এই পার্থক্যের কথা স্বীকার করেছে। (মাজমুয়ায়ে রাসায়েল-১/৩০৫)
আলবানীর অসার বক্তব্য:
আশ্চর্যের কথা হলো, উপরোল্লিখিত দলীলসমূহ এবং উম্মতের মাঝে নববী যুগ থেকে পর্যায়ক্রমে চলে আসা এই সর্বসম্মত আমলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আলবানী তার “সিফাতুস সালাতে” ঘোষণা দিয়ে দিলো যে, “পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতি এক”। নাঊযুবিল্লাহ!
কিন্তু এই দাবির পক্ষে সে না কোন আয়াত শরীফ পেশ করেছে, না কোন হাদীছ শরীফ। আর কোন ছাহাবী বা তাবেয়ীর ফতওয়া দেখাতে পারে নাই। এহেন বক্তব্যের ভিত্তি সে শুধু এটাকেই বানিয়েছে যে, পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতিগত পার্থক্যের ব্যাপারে কোন ছহীহ হাদীছ নাই। অথচ তার এই দাবি প্রমাণ করার জন্য উচিত ছিলো, উপরোল্লিখিত দলিলসমূহ বিশ্লেষণ করা। কিন্তু সে তা না করে কেবল পার্থক্য সম্বলিত একটি হাদীছকে {যা বক্ষ্যমান নিবন্ধে উল্লেখিত হয়েছে} শুধু এ কথা বলে জয়ীফ বলে আখ্যা দিয়েছে যে, হাদীছটি ‘মুরসাল’। আর মুরসাল হওয়ায় এটি দুর্বল। এছাড়া অন্য কোন আলোচনাই সে দলীল সম্পর্কে করেনি।
কিন্তু তার এই কথাটি একগুয়েমি ছাড়া কিছু নয়। কারণ মুহাদ্দিছীনে কিরামের নিকট হাদীছ মুরসাল হলেই তা অগ্রহণীয় হয়ে যায় না। কেননা প্রথমত আইম্মায়ে দ্বীনের অধিকাংশের মতে বিশেষত স্বর্ণযুগের ইমামগণের নিকট যদি প্রয়োজনীয় শর্তাবলী উপস্থিত থাকে তাহলে মুরসাল হাদীছও ছহীহ হাদীছের মত গ্রহণযোগ্য।
দ্বিতীয়ত: যে ইমামগণের নিকট ‘মুরসাল’ হাদীছকে ছহীহ বলার ব্যাপারে দ্বিধা রয়েছে উনারাও মূলত কিছু শর্তের সাথে মুরসাল হাদীছকে দলীল হিসেবে পেশ করার উপযোগী মনে করেন। প্রবন্ধের শুরুতে বর্ণিত মুরসাল বর্ণনাটিতেও সেসব শর্ত বিদ্যমান রয়েছে। যার কারণে গায়রে মুকাল্লিদদের বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিছ নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান “আউনুল বারী”-(১/৫২০ দারুর রাশীদ, হালাব সিরিয়া) তে লিখেছে, “এই মুরসাল হাদীছটি সকল ইমামের উছূল ও মূলনীতি অনুযায়ী দলীল হওয়ার যোগ্য”। তার পূর্ণ বক্তব্যটি দেখুন আওনুল বারী-২/১৫৯।
পুরুষ মহিলার নামাযের পার্থক্য নেই প্রমাণ করতে আলবানী দ্বিতীয় যে কাজটি করেছে তা খুবই গর্হিত কাজ। সেটা হলো, সে লিখেছে- হযরত ইবরাহীম নাখয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি নাকি বলেছেন, “মহিলারা পুরুষের মতই নামায আদায় করবে”। এই কথাটি নাকি মুছান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে আছে। অথচ সেই কিতাবের কোথাও এই উক্তিটি নাই।
অথচ ইতোপূর্বে মুছান্নাফে ইবনে আবী শাইবার একাধিক বর্ণনা ছহীহ সনদে ইবরাহীম নাখয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। যেখানে ইবরাহীম নাখয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি স্পষ্টই মহিলা পুরুষের নামাযের পার্থক্যের কথা বলেছেন।
আলবানী তার নিজের দাবি প্রমাণ করার জন্য তৃতীয় আরেকটি কাজ করেছে। সেটা হলো, ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার রিজালশাস্ত্রের একটি কিতাব “তারীখে ছগীর” থেকে নিম্নোক্ত বর্ণনাটি পেশ করেছেন-
عَنْ حَضْرَتْ اُمِّ الدَّرْدَاءِ اَنَّهَا كَانَتْ تَجْلِسُ فِى الصَّلَاةِ جَلْسَةَ الرَّجُلِ
“উম্মে দারদা থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি নামাযে পুরুষের মত বসতেন”।
আলবানী খেয়াল করতে পারেনি যে, এই বর্ণনাটি দ্বারা নামাযে পুরুষ ও মহিলার বসার ভিন্নতাই প্রমাণ হয়। এক হওয়া নয়। যদি উভয় বসার পদ্ধতি এক হতো, তাহলে “পুরুষের মত বসা” কথাটির কোন অর্থ থাকে না। তাই এই কথা থেকে এটি বুঝা যায় যে, সেই যামানায় পুরুষদের মত মহিলারা বসতো না। কিন্তু তিনি যেহেতু ভিন্নভাবে বসতেন তাই এটি ইতিহাসের বর্ণনায় চলে এসেছে।
আরেকটি মজার ব্যাপার হলো। উম্মে দারদা হলেন একজন তাবেয়ী। তিনি ৮০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তাবেয়ীর বক্তব্য দ্বারা আলবানী দলীল পেশ করেছে। অথচ সেই আবার আমাদের বর্ণিত প্রথম হাদীছটি মুরসাল বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। আশ্চর্য ব্যাপার!!
সুতরাং যদি নামাযের পদ্ধতি বর্ণনার ক্ষেত্রে তাবেয়ীর আমল দলীল হয়ে থাকে (আসলে কথা এটাই, অর্থাৎ তাবেয়ীর কথা দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য) তাহলে ইতোপূর্বে বিখ্যাত একাধিক তাবেয়ী ইমামগণের উদ্ধৃতিতে মহিলাদের নামাযের পদ্ধতির ভিন্নতার ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা গেছে এবং একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, আইম্মায়ে তাবেয়ীদের তা’লীম ও শিক্ষা অনুযায়ী রুকু, সিজদা ও বৈঠকসহ অনেক ক্ষেত্রে মহিলাদের নামায পদ্ধতি পুরুষ থেকে ভিন্ন ছিলো। এক্ষেত্রে শুধু একজন তাবেয়ী মহিলার ব্যক্তিগত আমলকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করাটা কিছুতেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। বিশেষ করে যখন এই বর্ণনাটির মাঝেই সুস্পষ্ট এ কথার ইঙ্গিত রয়েছে যে, বসার ক্ষেত্রে এ মহিলা অন্য ছাহাবী ও তাবেয়ী মহিলা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।
সুতরাং বুঝা গেলো, নামাযের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে মহিলারা পুরুষদের থেকে আলাদা। এটাই দলীল দ্বারা প্রমাণিত। গায়রে মুকাল্লিদদের বক্তব্যটির কোন দলীল নেই। মহান আল্লাহ তায়ালা তিনি আমাদের সত্যকে সত্য হিসেবে মেনে নেয়ার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন।
-আল্লামা সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালিম।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
মহিলাদের জন্য মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া জায়েয নেই
১৮ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
একখানা মহাসম্মানিত সুন্নাত মুবারক আমল করলে, মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে ৪টি নিয়ামত মুবারক
১৮ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য
১৭ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
পরকালে নেককার ও বদকারদের অবস্থা কিরূপ হবে
১৫ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
একমাত্র কাফিররাই হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে তাদের মতো মানুষ বলে
১৫ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কায়িনাতবাসীর সমস্ত নিয়ামত মুবারক বণ্টনকারী
১৫ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
একমাত্র কাফিররাই হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে তাদের মতো মানুষ বলে
১৩ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
মহিলাদের জন্য হাত, পা ও চেহারা আবৃত করে ঘর থেকে বের হওয়া ফরয। খোলা রেখে বের হওয়া হারাম, জায়েয বলা কুফরী (১৮)
১২ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য
১০ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
যে ৪ শ্রেণীর লোকদের জন্য ক্বিয়ামতের দিন সুপারিশ ওয়াজিব হবে
০৯ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
সবাইকে সর্বাবস্থায় হক্বের উপর ইস্তেকামত থাকতে হবে
০৮ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
একমাত্র কাফিররাই হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে তাদের মতো মানুষ বলে
০৬ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার)