কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অবহেলায় কৃষিতে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক; বাড়ছে ক্যান্সারের ঝুঁকি।
বিলুপ্তির পথে ১৯২ জাতের উপকারী পোকা।
সরকারের উচিত অবিলম্বে কীটনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রন করে জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও কৃষিকে বিষমুক্ত করা।
এডমিন, ২৫শে জুমাদাল ঊখরা শরীফ, ১৪৪৪ হিজরী সন, ২১ সামিন, ১৩৯০ শামসী সন, ১৯ই জানুয়ারি, ২০২৩ খ্রি:, ০৪ মাঘ, ১৪২৯ ফসলী সন, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) মন্তব্য কলাম

সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, দেশের কৃষি জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহার করে বিভিন্ন রকম ফসলের চাষাবাদ করে চাষিরা। বিভিন্ন এনজিওসহ কীটনাশক উৎপাদনকারী কোম্পানীদের প্রচারনার ফাঁদে পড়ে দেখা যায় দেশের কৃষকের ফলন বাড়াতে মাত্রাতিরিক্ত সার ও উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কীটনাশক ব্যবহার করে। ফলে ঝুঁকির মুখে পড়ছে দেশের কৃষি। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার কৃষকরাই কীটনাশক ব্যবহারে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন বলে জানা গেছে। তবে কী পরিমাণ মাটি ও পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে এখনই সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান সংশ্লিষ্টরা। কৃষিবিদরা জানাচ্ছেন, অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশের আবাদযোগ্য মাটির কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার উপর এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়নি। এ ক্ষতি পুষিয়ে আনতে গবেষণা দরকার।
উল্লেখ্য, পেস্টিসাইড ব্যবহার সহনীয় রাখতে সরকারের যে উদ্যোগ রয়েছে, তা কোনো কাজে আসছে না। একদিকে পেস্টিসাইড ব্যবহারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, আবার একই বিভাগে নতুন নতুন পেস্টিসাইড আমদানি করতে কোম্পানিগুলোকে লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। কোম্পানিগুলো নিজেদের আমদানি করা বালাইনাশক বিক্রির জন্য প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কৃষকদের উৎসাহিত করছে। ফলে কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর কৃষি বিভাগের উদ্যোগ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আমদানিকৃত কীটনাশক দেশের আবহাওয়া কতটা সংগতিপূর্ণ, তাও দেখা হচ্ছে না।
জানা গেছে, গাছ বাড়ার জন্য ১৭টি মৌলিক পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজন হয়। এসব পুষ্টি উপাদানের কিছু (হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও কার্বন) আসে পানি ও বাতাস থেকে। বাকি ১৪টি (নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, গন্ধক, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ক্লোরিন, লৌহ, ম্যাঙ্গনিজ, বোরন, দস্তা, তামা, মলিবডেনাম, কোবাল্ট) আসে মাটি থেকে। কিন্তু অতি কীটনাশক ও রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে দেশের মাটির ৬-৭টি মৌলিক পুষ্টি উপাদানের অভাব দেখা দিয়েছে। আগামী ২০-৩০ বছর পর আরও ৩-৪টি পুষ্টি উপাদানের অভাব দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে বেশি ফলন পাওয়ার অভাব দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
এক বছরের ব্যবধানে দেশে রাসায়নিকও কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ, পরিমাণে যা আট হাজার টন। চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর ও জার্মানি থেকেই আমদানি হয় পাঁচ ধরনের বালাইনাশক ও কীটনাশক। ইনসেকটিসাইড, ফাঙ্গিসাইড, হারবিসাইড, মিটিসাইড ও রোডেনটিসাইড বালাইনাশক আমদানি করা হয় মূলত দুভাবে- ফরমুলেটেড ও অ্যাকটিভ হিসেবে। বিসিপিএর তথ্যমতে, কৃষকরা ফসলে বালাইনাশক ও কীটনাশক ব্যবহার করে ৫২ হাজার ২৯৩ টন। এর মধ্যে ফরমুলেটেড ৩৭ হাজার ১৮৭ ও অ্যাকটিভ ১৫ হাজার ১০৬ টন। আর গতবছর থেকে এই ব্যবহারের ধারা বেড়েই চলেছে। আর এসকল কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহারের কারণে দেশের শস্যের উপকার করা ১৯২ টি উপকারী পোকা ধ্বংসের পথে।
খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্যই শুধু হুমকি নয়; জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্যও হুমকি। অথচ ক্ষতিকর এ রাসায়নিক ব্যবহারে নেই কোনো নজরদারি। বাংলাদেশে এগুলো নিষিদ্ধ থাকলেও ব্যাপকহারে তা আমদানি ও ব্যবহার হচ্ছে। সরকারের সামনে এগুলো ব্যবহার হলেও বন্ধ করার জন্য নেয়া হচ্ছে না কোনো পদক্ষেপ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে উৎপাদিত সবজিতে কীটনাশকের তীব্রতা বেশি হওয়ায় দেশ থেকে কমে যাচ্ছে সবজি রফতানি। শুধু তাই নয়, মাছ রফতানিতেও নানা দেশ থেকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে ৩য় অবস্থানে রয়েছে। আর এই অর্জন সরকারের অবহেলায় দেশের কৃষকদেরই অবদান। আর বাংলাদেশের সবজি খাত এতটাই সম্ভাবনাময় যে, সরকার যদি এই খাতে পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা করে তাহলে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করতে পারবে। আর এই কারণেই দেশবিরোধী একটি মহল এবং পাশ্ববর্তী দেশ ভারত চাচ্ছে বাংলাদেশের এই সম্ভাবনাময় খাতটি ধ্বংস করে দিতে। ফলে ভারত তাদের দেশ থেকে ক্ষতিকর বিভিন্ন কীটনাশক বাংলাদেশের বাজারে রফতানি করে দেশের সবজিখাততে বিষাক্ত করে দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার ধ্বংসের পায়তারা করছে। বাংলাদেশে ভারত থেকে নিষিদ্ধ হিলডন, ডিডিটি, ব্লিচিং পাউডারসহ বহুবিধ বিষাক্ত কীটনাশক এদেশে অনবরত প্রবেশ করছে।
পাশাপাশি কৃষি বিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এসব কীটনাশক প্রয়োগের পর সবজি ১৫ দিনের মধ্যে রান্না করে খেলে শরীরে নানা প্রকারের রোগ-ব্যাধি দেখা দিতে পারে। এছাড়া সবজিতে অনুমোদনপ্রাপ্ত কীটনাশকও প্রয়োগের পর কমপক্ষে এক সপ্তাহের পূর্বে ক্ষেত থেকে তুলে তা বিক্রি না করা এবং না খাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। অথচ কীটনাশক ব্যবহারের পরদিনই কৃষকরা জমি থেকে সবজি তুলে বাজারে বিক্রি করে। এর ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অভিজ্ঞমহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, যদি বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে সমন্বিত রোগ-ব্যাধি ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) অনুসরণ করা না হয়, তবে কৃষি ক্ষেত্রে বিশেষ করে সবজি উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমানে বিশ্বের ২৬টি দেশের ২ কোটি ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে জৈবিক উপায়ে কৃষিপণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোও এদিক থেকে পিছিয়ে নেই কারণ সেখানেও কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিকের ব্যবহার বাদ দিয়ে শুধুমাত্র জৈবিক পদ্ধতির চাষাবাদের আওতায় এসেছে প্রায় ২ কোটি হেক্টর কৃষি জমি।
সঙ্গতকারণেই আমরা মনে করি, আমাদের দেশেও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে এনে জৈবিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শস্যের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি সম্ভব। আর এতে করে কৃষির পাশাপাশি ক্ষতিকর কীটনাশকের হাত থেকে পরিবেশও রক্ষা পাবে।
-মুহম্মদ ওয়ালীউর রহমান।