ইলমে তাছাওউফ
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৩৮)
কামিল শায়েখ উনার প্রতি সর্বক্ষেত্রে বিশুদ্ধ আক্বীদা ও হুসনে যন পোষণ করা মুরীদের জন্য কামিয়াবী হাছিলের কারণ
, ২৪ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০:০০ এএম ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) ইলমে তাছাউফ

(গত ৮ রমাদ্বান শরীফের পর)
কেননা মহান আল্লাহ পাক উনার নৈকট্য মুবারক লাভের চেষ্টায় নিমগ্ন থাকা সুলূকের পথে সালিক বা মুরীদের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান যে, এ সময় সালিক যেমন প্রতি-মুহূর্তে আত্মিক উন্নতি ও অগ্রগতির দিকে দ্রুত ধাবিত হয়, বিভিন্ন মাকামের সাথে সম্পৃক্ত হয়। তেমনি অবনতি ও মারাত্মক ক্ষতিরও সম্ভাবনা থাকে প্রবল।
মানব জীবনের প্রধান শত্রু ইবলীস। ইবলীস সালিক বা মুরীদের এ উন্নতি ও অগ্রগতিকে সহ্য করতে পারে না। তাই সুলূকের পথে মহা বিপর্যয় সৃষ্টি করতে সে সদা তৎপর। মুরীদকে সে নানা প্রকার প্রলোভন দেখাতে থাকে। সেক্ষেত্রে মুরীদ কোন কোন সময় নিজেকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাশীল মনে করার অবকাশ পায়। ফলে উন্নতি ও অগ্রগতির পরিবর্তে অধঃপতনের যাত্রা শুরু হয়।
এ প্রসঙ্গে ইমামে রব্বানী, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “সালিক উরুজ বা উর্ধ্বারোহণকালে অনেক সময় ঐ সকল ব্যক্তিবর্গের মাকামের ঊর্ধ্বে নিজেকে উপনীত হতে দেখে, যাদের শ্রেষ্টত্ব ও বুযূর্গী-সম্মান সর্বস্বীকৃত ও সর্ববাদী। ”
এ সর্ববাদী শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গকে নিজের চেয়ে অতি নগন্য মনে করা, মুরীদের পদস্খলনের একটি দিক। পাপমতি ইবলীসের বহুমুখী কুতৎপরতার এবং মুরীদের পদস্খলনের আরো অনেক দিক রয়েছে। তন্মধ্যে যেটি সবচেয়ে বিষ সদৃশ বা অত্যন্ত ক্ষতিকারক তা হচ্ছে- স্বীয় পীর ছাহেব অর্থাৎ শায়েখ উনার পবিত্রতম ছোহবত মুবারক বা উনার সংসর্গ, নৈকট্য মুবারককে অবমূল্যায়ন করা, ছোহবত মুবারক থেকে বিমুখ হওয়া। কেননা ছোহবত থেকে বিরত হলেই শয়তানের কর্তব্য কাজ সহজেই সম্পাদিত হয়। মুরীদকে ইচ্ছামত পরিচালিত করতে পারে। এমতাবস্থায় সালিক যদি শায়েখ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার ছোহবত মুবারক থেকে সরে পড়ে তখন সে যেমন মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয় তেমনি ইবলীস শয়তানও সালিককে মহান আল্লাহ পাক ও নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে হাছিল করার পথ থেকে সরিয়ে দেয়ার সর্বনিকৃষ্ট কাজে সফল হয়ে অত্যন্ত খুশি হয়। নাঊযুবিল্লাহ!
এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে যে, সাইয়্যিদুত ত্বয়িফা, হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার এক মুরীদের একবার ধারণা হলো, “আমি কামিল ওলীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছি। কাজেই আমার জন্য আর পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার ছোহবতে না থেকে নির্জনে একাকী থাকাই উত্তম। ” এ ভেবে সে নির্জনে অবস্থান করতে লাগলো।
একদিন গভীর রাতে কয়েকজন লোক সেখানে উট নিয়ে উপস্থিত হয়ে বললো, আপনাকে বেহেশতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা এসেছি। আপনি আমাদের সাথে চলুন। উক্ত দরবেশ তাদের সাথে উটে আরোহণ করে রওয়ানা হলো। বেশ কিছুক্ষণ ভ্রমণের পর তাকে একটি মনোরম স্থানে নিয়ে তারা উপস্থিত হলো। এখানে সুন্দর সুন্দর লোক, নানা জাতীয় উপাদেয় খাদ্য, সুমিষ্ট ফল ও বাগান রয়েছে। সম্মুখে সুপেয় পানির নহর প্রবাহিত হচ্ছে। পবিত্র ফজর উনার পূর্ব পর্যন্ত সেখানে সে অবস্থান করতো, তার কথিত বেহেশতের স্বাদ উপভোগ করতো, অতঃপর ঘুমিয়ে পড়তো। নিদ্রা ভঙ্গ হলে সে নিজেকে দেখতে পেতো, সে তার ঘরের দরজায় পড়ে রয়েছে। বেশ কিছুদিন এভাবে চলতে থাকে। সে নিয়মিত উটে আরোহণ করে তার কথিত বেহেশতে ভ্রমণ করে, বেহেশতে আহার করে। ফলে তার মধ্যে আরো বেশী অহঙ্কার ও গৌরব বদ্ধমূল হয়ে গেলো। এক পর্যায়ে সে তার বুযূর্গী সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার দাবি করতে লাগলো।
পর্যায়ক্রমে এ খবর গিয়ে পৌঁছলো সাইয়্যিদুত ত্বয়িফা, হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে। একদিন তিনি সে দরবেশের খানকায় গিয়ে দেখলেন, সে খুব শান-শওকতের সাথে বসে আছে। সাইয়্যিদুত ত্বয়িফা, হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি তার অবস্থা জানতে চাইলেন। সে আগাগোড়া সমস্ত কথা বর্ণনা করলো। সাইয়্যিদুত ত্বয়িফা, হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “আজ রাতে তুমি তোমার কথিত সেই বেহেশতে পৌঁছলে অবশ্যই তিনবার-
لَاحَوْلَ وَلَا قُوَّةَ اِلَّا بِاللهِ الْعَلِىِّ الْعَظِيْمِ
“লা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম” এই দোয়া পড়ে ফুঁ দিবে।
পরবর্তী রাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো, সে উটে সওয়ার হয়ে তার সেই কথিত বেহেশতে গিয়ে পৌঁছলো। সুলত্বানুল আরিফীন, হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার প্রতি তার বিশ্বাস ছিলো না, তারপরও অনিচ্ছাসত্ত্বে পরীক্ষামূলকভাবে উনার শিখানো-
لَاحَوْلَ وَلَا قُوَّةَ اِلَّا بِاللهِ الْعَلِىِّ الْعَظِيْمِ
অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক উনার সাহায্য ব্যতীত (শয়তানের ধোঁকা হতে বিরত থাকা এবং নেক কাজে মশগুল হওয়ার) ক্ষমতা ও শক্তি কারো নেই” এ দোয়া সে পড়লো। এই কালিমাটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র উপস্থিত সকলেই প্রমোদ আসর ভেঙ্গে চিৎকার করে তাকে একাকী ফেলে, যে যেদিকে পথ পেলো পালিয়ে গেলো। অতঃপর সে নিজেকে আবিষ্কার করলো, সে একটি নাপাক ও অতি ময়লাযুক্ত স্থানে বসা ও তার চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে মৃত ব্যক্তিদের হাড়-গোড়। এই দৃশ্য দেখে সে চমকে উঠলো ও নিজের ভুল বুঝতে পেরে খালিছ তওবা করলো। পুনরায় সুলত্বানুল আরিফীন, হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দরবার শরীফে গিয়ে হাজির হলো। এখন তার অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস হলো যে, মুরীদের পক্ষে মুর্শিদ ক্বিবলা উনাকে ছেড়ে একাকী নির্জনে অবস্থান করা বিষতুল্য। (তাযকিরাতুল আওলিয়া, মাকতুবাতে সদী) (অসমাপ্ত)
-আল্লামা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমাতে তাছাউফ চর্চা
১২ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
পবিত্র ইলমে ফিক্বাহ ও পবিত্র ইলমে তাছাউফ অর্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
০৯ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৪১)
২৯ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৪০)
২৮ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৩৯)
২৫ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত বড়পীর ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাওয়ানেহ উমরী মুবারক (১৪)
২৩ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
মুহলিকাত তথা বদ স্বভাবসমূহ
০৭ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
পবিত্র মুনজিয়াত উনার বিবরণ
০৫ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ওলীআল্লাহ উনাদের ছোহবতে যাওয়া ব্যতীত কারো পক্ষে প্রকৃত মু’মিন-মুসলমান হওয়া সম্ভব নয়
০৫ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত বড়পীর ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাওয়ানেহ উমরী মুবারক (১২)
০৪ এপ্রিল, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
হযরত শায়েখ আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি (৬)
২৬ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
হযরত শায়েখ আবূ বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি (৫)
২৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার)