ইতিহাস
ইংরেজদের আতঙ্ক বাংলার বীর মুহম্মদ তকী খাঁ’র বীরত্ব
, ১২ শা’বান শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ১৫ তাসি’, ১৩৯২ শামসী সন , ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রি:, ২৯ মাঘ, ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) ইতিহাস
১৭৫৭ সালে বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। এরপর ইংরেজদের থেকে বাংলাকে মুক্ত করতে অনেক বীর শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন। যাদের কথা ইতিহাসে খুব কমই আলোচিত হয়। তাদেরই মধ্যে একজন মুহম্মদ তকী খাঁ। আজকের পর্বে তার বীরত্বের ইতিহাসই আমরা জানবো।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় এবং ইন্তেকালের পর ক্ষমতায় আসে মীর জাফর। তবে যে সিংহাসনের জন্য বেনিয়া ব্রিটিশদের সাথে হাত মিলিয়েছিলো মীর জাফর সেই সিংহাসনের স্থায়ীত্ব হলো মাত্র চার বছর। এরপর তাকে জোর করে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে বসানো হয় তারই জামাতা মীর মুহম্মদ কাশিম আলী খাঁ নসরত জঙ্গী বাহাদুরকে। যিনি ইতিহাসে মীর কাশিম নামেই বেশি মশহুর।
মীর কাশিম ভেতর থেকে ছিলেন ইংরেজবিদ্বেষী। তিনি চাচ্ছিলেন শেষবারের একটা চেষ্টা করে দেখতে। বাংলার মুলুক থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করা যায় কিনা। তিনি ক্ষমতায় এসে দেখলেন রাজকোষ একেবারেই শূণ্য। ইংরেজরা বিনা শুল্কে সবজায়গায় বাণিজ্য করে মুনাফা লুটে নিচ্ছে। বিপরীতে স্থানীয় মুসলিম বণিকদের অত্যাচার নির্যাতন এবং পরিশেষে গুম করে দিচ্ছে।
তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আগে রাজকোষ শক্তিশালী করবেন এবং সাধারণ জনগণের উন্নয়ন করবেন। এজন্য তিনি সকল বিলাসীতা পরিত্যাগ করলেন। তিনি ভাবলেন মিশরের সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি, সিরিয়ার সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী রহমতুল্লাহি আলাইহি, বাদশাহ নাছীরুদ্দীন মাহমুদ হুমায়ুন, বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীর রহমতুল্লাহি আলাইহি সবাই সকল বিলাসীতা ছেড়ে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে শত্রুদের দমন করেছিলেন। মীর কাশিমও উনাদেরই পথ অনুসরণ করলেন। তিনি ইংরেজদের ব্যবসায়ীদের উপর বাণিজ্য শুল্ক আরোপ করলেন। কিন্তু তাতে তেমন কাজ হলো না। তখন তিনি কৌশলে বাণিজ্য শুল্কই উঠিয়ে নিলেন। এবার ইংরেজদের স্বার্থে আঘাত পড়লো। কারণ বাণিজ্য শুল্ক এদেশীয় ব্যবসায়ীদের জন্যও ছিলো। এবার উঠিয়ে দেয়ায় দেশীয় ব্যবসায়ীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিলো। ইংরেজদের যেহেতু এজেন্ডা ছিলো এদেশীয় বাণিজ্য ধ্বংস করা তাই তারা মীর কাশিমের বিরুদ্ধে অবস্থা নিলো। মীর কাশিমও বুঝতে পারলেন যে, ইংরেজদের সাথে এবার যুদ্ধ ছাড়া উপায় নেই। তিনিও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন।
নবাব মীর কাশিমের সেনাপতি ছিলেন সুশিক্ষিত অশ্বারোহী ও সমরবিদ মুহম্মদ তকী খাঁ। মীর কাশিমের আদেশে তিনি সেনাদল নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা দিলেন। অজয় নদীর তীরে ইংরেজদের সাথে তকী খাঁর যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে ইংরেজদের পিছিয়ে যেতে হয়। এরপর তকী খাঁ দ্রুত কাটোয়ায় উপস্থিত হন এবং সেখানে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়। তবে এবারও সিরাজউদ্দৌলার মতো বিশ্বাসঘাতকদের কবলে পড়তে হয় তকী খাঁকে। তার সহযোগী সকল সেনাধিনায়ক ইংরেজদের কাছে বিক্রি হয়ে যায় এবং যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তিনি তখন উনার সাথে থাকা কিছু সৈন্য নিয়েই ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন।
যুদ্ধ শুরু হলো। ইংরেজরা মনে করেছিলো তকী খাঁর সামান্য সৈন্য তারা সহজেই ধরাশায়ী করবে। কিন্তু তকী খাঁর সাথে যেসকল সৈন্য ছিলো তারা সবাই ছিলো প্রচন্ড ইংরেজবিরোধী। তাই সবাই প্রাণপণে যুদ্ধ করছিলো। পুরো ময়দান ইংরেজ সৈন্যের লাশে ভরে গেলো। তকী খার অনেক বিশ্বস্ত সৈন্যও শহীদ হলো। তকী খাঁও সাথে থাকা আফগান ও মুঘল সৈন্যরাও ইংরেজদের লাশের সারি বিছিয়ে দিলো। ইংরেজরা প্রায় ধরাশায়ী। তারা পলায়নের চিন্তা করছে। ঠিক এমন সময় ইংরেজদের ছোড়া একটি গোলা এসে পড়লো তকী খাঁর পায়ের কাছে। ব্যাপক আহত হলেন। উনার প্রিয় ঘোড়াটি মারা গেলো। কিন্তু এরপরও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকলেন। দ্বিতীয় একটি ঘোড়াতে তিনি তরবারী চালাতে লাগলেন।
ঠিক এমন মুহুর্তে ইংরেজদের বন্দুকের একটি গুলি এসে তকী খাঁর ঘাড়ে এসে লাগে। গুরুতর আহত হন তিনি। এরপরও লাফিয়ে তিনি ঘোড়ায় উঠে পড়েন এবং আফগান ও মুঘল সৈন্যদের উদ্দেশ্য আরো তীব্রবেগে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেন। এত গুরুতর আহত হওয়ার পর উনার চেহারায় ব্যাথা-বেদনার লেশমাত্র ছিলো না। তবে উনার দ্বিতীয় ঘোড়াও মারা গেলো। এবার তিনি হুংকার দিয়ে তৃতীয় একটি ঘোড়াতে উঠে একাই ইংরেজদের ভেতর ঢুকে গেলেন। তখন সেখানে থাকা শত শত ইংরেজ সৈন্য ভয়ে বন্দুক-সামগ্রী ফেলেই পালাতে শুরু করলো। তকী খাঁ একাই তাদের ধাওয়া করলেন। তবে ইংরেজরা যেহেতু ধূর্ত ও কাপুরুষ তাই তারা কিছু সৈন্যকে একটি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলো। ত্বকী খাঁ যখন সেই ঝোপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন তখন তারা বন্দুক দিয়ে তকী খাঁর মাথা বরাবর গুলি করলো। সাথে সাথেই শহীদ হলেন মুহম্মদ তকী খাঁ। তার শাহাদাতের সাথে সাথে বাংলার স্বাধীনতার শেষ আশাটুকুও নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।
-মুহম্মদ শাহ জালাল।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কেমন ছিলো মোঘল সালতানাতের গোলন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
পান্থনিবাস ও সরাইখানা নির্মাণে মুসলমানদের অনবদ্য অবদান
২৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৯)
১৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার বিরোধিতায় বিধর্মী-অমুসলিমরা
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার হিন্দু ধনিক-বণিক, বেনিয়া শ্রেণী, ব্যাংকার প্রভৃতির সাথে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইউরোপকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন আফ্রিকান মুসলমানরা
১২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
গুজরাটের সুলতান মুজাফফর শাহের পরহেজগারিতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ
০২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৭)
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
কেমন ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ঐতিহাসিক মুসলিমবাগ ঈদগাহ-ই কি আজকের ঢাকেশ্বরী মন্দির?
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
১২টি চন্দ্রমাসের নাম এবং নামকরণের সার্থকতা (২)
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ঐতিহাসিক খেমকারান যুদ্ধ: যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের উদ্ভব
২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)












