পবিত্র শবে বরাত উনার রোযা নিয়ে বিভ্রান্তি নিরসন
, ১৩ শা’বান শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ১৬ তাসি’, ১৩৯২ শামসী সন , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রি:, ৩০ মাঘ, ১৪৩১ ফসলী সন, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) পবিত্র দ্বীন শিক্ষা

পবিত্র শবে বরাত বিরোধীদের শবে বরাত নিয়ে বিভ্রান্তির শেষ নেই। শবে বরাত অর্থাৎ পবিত্র শা’বান শরীফ মাসের ১৫ তারিখ রোযার কোনো দলীল শরীয়তে নেই। এই দিনে পবিত্র বরাত উপলক্ষে রোযা রাখলে সেটা বিদয়াত হয়ে যাবে। এরকম কিছু আযগুবী কথা-বার্তা প্রচার করতে শুনা যায় শবে বরাত বিরোধীদের কাছ থেকে। আসলে কি তাই? বাস্তবতা কি বলে? প্রথমে আমরা দেখবো, ইসলামী শরীয়তে পবিত্র শা’বান শরীফ মাসের ১৫ তারিখে কোনো রোযার বর্ণনা আছে কিনা। বেশি দূরে যেতে হবে না ছিহাহ সিত্তার অন্যতম কিতাব ‘ইবনে মাজাহ শরীফে’ই শবে বরাতে রোযা রাখার বিষয়টা বর্ণিত রয়েছে।
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ الْخَلاَّلُ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ، أَخْبَرَنَا ابْنُ أَبِي سَبْرَةَ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ بْنِ مُحَمَّدٍ ، عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ جَعْفَرٍ ، عَنْ أَبِيهِ ، عَنْ الامام الاول سيدنا حضرت عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ عليه السلام قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ : إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ ، فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا ، فَإِنَّ اللَّهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا ، فَيَقُولُ أَلاَ مِنْ مُسْتَغْفِرٍ لِي فَأَغْفِرَ لَهُ أَلاَ مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ أَلاَ مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ أَلاَ كَذَا أَلاَ كَذَا حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ
অর্থ: সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুল আউওয়াল কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যখন মধ্য শা’বানের পবিত্র রাত আসবে তখন তোমরা এ রাতে নামায আদায় করবে অর্থাৎ ইবাদত-বন্দেগী, দোয়া-মুনাজাত করবে এবং দিনের বেলা রোযা রাখবে। কেননা এই রাত্রি মুবারকে সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মহান আল্লাহ পাক তিনি পৃথিবীর আকাশে নাযিল হন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর বান্দাদেরকে বলতে থাকেন, তোমাদের মধ্যে কেউ ক্ষমাপ্রার্থী আছো, আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো। তোমাদের মধ্যে কেউ রিযিকপ্রার্থী আছো, আমি তাকে রিযিক দান করবো। তোমাদের মধ্যে কেউ মুছীবত গ্রস্থ আছো, আমি তার মুছীবত দূর করে দিব। এভাবে মহান আল্লাহ পাক তিনি ফজর উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বান্দাদেরকে ডাকতে থাকেন। সুবহানাল্লাহ! (ইবনে মাজাহ শরীফ : পবিত্র হাদীছ শরীফ নং ১৩৮৮, আখবারু মক্কা লিল ফাকিহী ৩/৮৪, তারতীবুল আমালী ১/৩৭২ ইত্যাদি)
উক্ত হাদীছ শরীফে বরাতের রাতে ইবাদত-বন্দেগী এবং দিনে রোযা রাখার কথা বলা হয়েছে। এই হাদীছ শরীফখানা নিয়ে তারা অপপ্রচার করে যে, এটা নাকি জাল হাদীছ। নাঊযুবিল্লাহ! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই হাদীছ শরীফ উনার একজন রাবী ব্যতীত সমস্ত রাবীই ছিক্বাহ বা বিশ্বস্ত। সেই রাবী হচ্ছেন, ইবনে আবী সাবরাহ। উনাকে ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি দ্বঈফ বলেছেন, ইমাম যাহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, তিনি বড় ফক্বীহ ও ইরাকের কাজী ছিলেন। ইমাম নাসায়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনাকে মাতরুকুল হাদীছ বলেছেন। ইমাম হাম্বলী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনাকে হাদীছ শরীফ জাল করতেন বলে মন্তব্য করেছেন। এরকম আরো অনেকেই পক্ষে বিপক্ষে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু বিরোধিরা শুধু উনার বিপক্ষের মতামতগুলো উল্লেখ করে এই হাদীছ শরীফখানাকে জাল বলে দিচ্ছে। সবার বক্তব্য পর্যালোচনা করলে উনাকে সর্বোচ্চ দ্বঈফ প্রমাণিত করা যায়। কেননা উনার স্মরণশক্তি কিছুটা দুর্বল থাকার কারণে উনাকে দুর্বল বলা হয়েছে। যেটা ইমাম যাহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-
وَهُوَ ضَعِيْفُ الحَدِيْثِ مِنْ قِبَلِ حِفْظِه
অর্থ: তিনি দ্বঈফুল হাদীছ, স্মরণশক্তির দুর্বলতার কারণে। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১৩/৩৭৪)
হযরত যুরক্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বিষয়টাকে আরো স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেন-
"وفي سنن ابن ماجه بإسناد ضعيف" كما جزم به المنذري والعراقي مبينا وجه ضعفه، لكن ليس فيه كذاب ولا وضاع وله شواهد تدل على ثبوت أصله
অর্থ: আর সুনানে ইবনে মাজাহ’র মধ্যে দুর্বল সনদে বর্ণিত রয়েছে। যেমনটা হযরত মুনযিরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এবং হযরত যাইনুদ্দীন ইরাক্বী রহমতুল্লাহি তিনি অর্থাৎ উনারা নিশ্চিতভাবে এর দুর্বলতার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এর সনদে কোনো মিথ্যাবাদী ও জাল রাবী নেই। তাছাড়া এই সনদের শাওয়াহিদ রয়ে গেছে। যা এই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার আছল রয়েছে এটাই প্রমাণ করে। (শরহুয যারক্বানী আলাল মাওয়াহিব ৭/৪১২)
তাছাড়া হযরত ইবনে জাওযী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি, হযরত বূছীরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এবং আব্দুর রশীদ নোমানী উনারা ইবনে মাজাহ শরীফ উনার থেকে ১৭টি জাল হাদীছ প্রমান করেছেন। উনারা কেউই উপরোক্ত হাদীছ শরীফকে জাল বা মওযু বলেননি।
উপরোক্ত ইমাম উনাদের আলোচনা দ্বারা এই হাদীছ শরীফখানাকে সর্বোচ্চ দ্বঈফ বলা যেতে পারে। আমল করার জন্য দ্বঈফ হাদীছ শরীফই যথেষ্ট। আর হযরত মুনযিরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এবং হযরত যাইনুদ্দীন ইরাক্বী রহমতুল্লাহি তিনি অর্থাৎ উনারা বলেছেন, এই হাদীছ শরীফ উনার শাহেদ রয়েছে। সেই হিসেবে হাসান হওয়ারই দাবী রাখে। যারা এই হাদীছ খানাকে জাল-মওযু বলে প্রচার করছে তারা মূলত মিথ্যাচার করছে। কাজেই পবিত্র শবে বরাতে রোযা রাখার দলীল সুস্পষ্ট।
আশরাফ আলী থানভী দেওবন্দী সেও শবে বরাতের রোযা রাখার বিষয়টি স্বীকার করেছে। সে তার বেহেশতী জেওর কিতাবে বলেছে-
شب برآت کی اتنی اصل ہے کہ پندرہويں رات اور پندرہواں دن اس مہينے کا بہت بزرگی اور برکات ہے ہمارے پيغمبر نے اس رات کو جاگنے کی اور دن کو روزه رکهنے کی رغبت دلائی ہے
অর্থ: পবিত্র শবে বরাতের এতটুকু ভিত্তি আছে যে, এ মাসের পনের তরীখ দিবারাত্রি মহাসম্মানিত ও বরকতময়। আমাদের মহাসম্মানিত নবী ও রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এ রাতে জেগে ইবাদত করার এবং দিনে রোযা রাখার জন্য উৎসাহিত করেছেন। সুবহানাল্লাহ! (বেহেশতী জেওর ৬/২৯৬)
পুরো বছরে ৫ দিন রোযা রাখা নিষেধ। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আদ্বহা এবং ঈদুল আদ্বহার পরের ৩ দিন অর্থাৎ পবিত্র যিলহজ্জ শরীফ মাসের ১১, ১২, এবং ১৩ তারিখ। এছাড়া আর কোনো দিন রোযা রাখার নিষেধাজ্ঞা শরীয়তে নেই।
মূলকথা হলো পবিত্র শা’বান শরীফ মাসের ১৩, ১৪ এবং ১৫ তারিখ রোযা রাখা সম্মানিত সুন্নত মুবারক উনার অন্তর্ভুক্ত। তাই বাতিলদের কথায় প্রভাবিত না হয়ে এই দিনসমূহে রোযা রাখাই প্রত্যেক মু’মিন-মুসলমানদের দায়িত্ব-কর্তব্য।
মহান আল্লাহ পাক তিনি সকলকে সেই তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!
-হাফিয মুহম্মদ ইমামুল হুদা
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
সম্মানিত যাকাত উনার আহকাম, মাসায়িল ও ফাযায়িল (৬)
২৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
পর্দা পালন করা নারী-পুরুষ সকলের জন্যই শান্তি ও পবিত্রতা হাছিলের কারণ
২৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
২৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
তারা প্রত্যেকেই মূর্তিপূজারী ও মুশরিক হয়ে কাট্টা কাফির ও মুরতাদ হয়েছে (২২)
২৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘পহেলা এপ্রিল’ বা ‘এপ্রিল ফুল’ হারাম। ‘এপ্রিল ফুল’ এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (১)
২৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, রহমাতুল্লিল আলামীন, ক্বয়িদুল মুরসালীন, রউফুর রহীম, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র জীবনী মুবারক (২২৭৬)
২৫ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
সম্মানিত যাকাত উনার আহকাম, মাসায়িল ও ফাযায়িল (৫)
২৪ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
ছবি তোলা শক্ত হারাম, রয়েছে কঠিন শাস্তি
২৪ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
সাইয়্যিদুনা হযরত সুলত্বানুন নাছীর আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র ওয়াজ শরীফ
২৪ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
‘গরুর গোস্তে রোগ আছে’ এই সংক্রান্ত বাতিল হাদীছ ও তার খন্ডনমূলক জবাব
২৪ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
একদিকে রুজু থেকে মহান আল্লাহ পাক উনার এবং উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সন্তুষ্টি মুবারক হাছিলের উদ্দেশ্যে দ্বীনি ইলম শিক্ষা করতে হবে, তাহলেই কামিয়াবী
২৪ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) -
সম্মানিত যাকাত উনার আহকাম, মাসায়িল ও ফাযায়িল (৪)
২৩ মার্চ, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার)