বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ০৭)
, ০১ যিলক্বদ শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ০১ ছানী আ’শার, ১৩৯২ শামসী সন , ৩০ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রি:, ১৭ বৈশাখ, ১৪৩২ ফসলী সন, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) ইতিহাস

মুসলমান লাখেরাজদারদের ন্যায্য ভূমির মালিকানা থেকে উচ্ছেদ করার জন্যে নানাবিধ হীনপন্থা অবলম্বন করা হতো এবং ব্রিটিশ কর্মচারীদের মধ্যে এ ব্যাপারে এক বিদ্বেষদুষ্ট মানসিকতা বিরাজ করতো। লাখেরাজদারদের সনদ রেজিষ্ট্রি না করার কারণে বহু লাখেরাজ বাজেয়াপ্ত করা হয়। জেলার কালেক্টরগণ ইচ্ছা করেই সময় মতো সনদ রেজিষ্ট্রি করতে গড়িমসি করতো। তার জন্যে চেষ্টা করেও লাখেরাজদারগণ সনদ রেজিষ্ট্রি করাতে পারতেন না।
চট্টগ্রামে লাখেরাজদারদের কোর্টে হাজির হবার জন্যে কোন নোটিশই দেয়া হতো না। অনেকক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে, মামলার ডিক্রী জারী হবার বহু পূর্বেই সম্পত্তি অন্যত্র পত্তন করা হয়েছে।
১৮২৮ থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সমগ্র বাংলা বিহারে লাখেরাজদারদের মিথ্যা তথ্য সংগ্রহের জন্যে চর, ভুয়া সাক্ষী ও রিজাম্পশন অফিসার পঙ্গপালের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুসলমানদেরকে মামলায় জড়িত করে। উদ্দেশ্য মুসলমানদেরকে হেনস্থা করা।
এসব মামলায় সরকার ছাড়াও তৃতীয় একটি পক্ষ বিরাট লাভবান হয়। যারা মিথ্যা সাক্ষ্যদান করে এবং যারা সরকারী কর্মচারীদের কাছে কাল্পনিক তথ্য সরবরাহ করে তারা প্রভূত অর্থ উপার্জন করে। পক্ষান্তরে, মুসলিম উচ্চশ্রেণী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার ফলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যায়।
জওহরলাল নেহরু বলেছে, ব্রিটিশরা বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে বহু ‘মুয়াফী’ অর্থাৎ লাখেরাজ ভূ-সম্পত্তির অস্তিত্ব ছিলো। তাদের অনেক ছিলো ব্যক্তিগত, কিন্তু অধিকাংশই ছিলো শিক্ষায়তনগুলির ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে ওয়াকফকৃত। প্রায় সকল প্রাইমারী স্কুল, মক্তব এবং বহু উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান এসব ‘মুয়াফীর’ আয় নির্ভর ছিলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বিলাতে তাদের অংশীদারগণকে মুনাফা দেয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি টাকা তোলার প্রয়োজনবোধ করে। কারণ কোম্পানী ডিরেক্টরগণ এজন্যে খুব চাপ দিচ্ছিলো। তখন এক সুপরিকল্পিত উপায়ে ‘মুয়াফীর ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নীতি গৃহীত হয়। এসব ভূ-সম্পত্তির স্বপক্ষে কঠিন সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করার হুকুম জারী করা হয়।
কিন্তু পুরোনো সনদগুলি ও সংশ্লিষ্ট দলিলপত্র ইতিমধ্যে হয় কোথাও হারিয়ে গেছে, না হয় পোকায় খেয়ে ফেলেছে। অতএব প্রায় সকল ‘মুয়াফী’ বা লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলো। বহু বনেদী ভূ-মধ্য অধিকারী স্বত্বচ্যুত হলেন। বহু স্কুলে কলেজের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেলো। এভাবে মুসলমানদের বহু জমি ব্রিটিশ বেনিয়া সরকারের খাস দখলে আসে আর বহু বনেদী বংশ উৎখাত হয়ে যায়। এ পর্যন্ত যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপরোক্ত ‘মুয়াফী’র আয় নির্ভর ছিলো, সেগুলি বন্ধ হয়ে গেলো। বহু সংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগীয় কর্মচারী বেকার হয়ে পড়লো। (Pandit Jawhellal Nehru: The Discovery of India, pp. 376-77)
উচ্চ ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর মুসলমানদের জীবিকা অর্জনের তৃতীয় অবলম্বন ছিলো সরকারের অধীনে চাকুরী-বিচার ও প্রশাসনিক বিভাগগুলিতে। কোম্পানী দেওয়ানী লাভের পরও প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবত তারা চাকুরীতে বহাল ছিলো। কারণ তখন পর্যন্ত সরকারী ভাষা ছিলো ফারসী। কিন্তু হঠাৎ আকস্মিকভাবে ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজীকে সরকারী ভাষা করা হয়। মুসলমানরা তার জন্যে পূর্ব থেকে মোটেই প্রস্তুত ছিলো না।
১৮৩২ সালে সিলেক্ট কমিটির সামনে ক্যাপ্টেন টি ম্যাকাম প্রস্তাব পেশ করে যে, ক্রমশঃ ইংরেজী ভাষার প্রচলন করা হোক এবং মুসলমান কর্মচারীদেরকে অন্ততঃ পাঁচ-ছয় বছরের অবকাশ দিয়ে নোটিশ দেয়া হোক।
হন্ট ম্যাকেঞ্জীও অনুরূপ প্রস্তাব পেশ করে বলে, জেলাগুলিতে ক্রমশঃ ইংরেজীর প্রচলন করা হোক।
সহসা সর্বত্র এ পরিবর্তন সাধিত হওয়ার ফলে হাজার হাজার মুসলমান কর্মচারী চাকুরী থেকে অপসারিত হন যাদের জীবিকা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতো একমাত্র চাকুরীর উপর। ১৮২৯ সালে সব রকম শিক্ষার বাহন হিসাবে স্কুল-কলেজে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা দেয়া শুরু হয়। ১৮৩৭ সালের ১লা এপ্রিল থেকে (তৎকালীন আর্থিক বৎসরের প্রথম দিন) সহসা সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরেজীর প্রবর্তন হয়।
হান্টারও এসব সত্য স্বীকার করে বিদ্রুপ করে বলেছে-“এখন কেবলমাত্র জেলখানায় দু’একটা অধঃস্তন চাকুরী ছাড়া আর কোথাও ভারতের এই সাবেক প্রভুরা (মুসলমানরা) ঠাঁই পাচ্ছে না। বিভিন্ন অফিসে কেরানীর চাকুরীতে, আদালতের দায়িত্বশীল পদে, এমনটি পুলিশ সার্ভিসের উর্ধ্বতন পদগুলিতে সরকারী স্কুলের উৎসাহী হিন্দু যুবকদেরকে নিযুক্ত করা হচ্ছে”।
এ পরিবর্তনের ফলে হিন্দুত্ববাদীরা পূর্ণ সুফল ভোগ করে। বিভিন্ন কলেজ থেকে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা করে তারা সর্বত্র সরকারী চাকুরীতে একচেটিয়া অধিকার লাভ করে। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক অঙ্গনে পট পরিবর্তনের ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারসমূহ জীবিকা অর্জনের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে দারিদ্র্য, অনাহার ও ধ্বংসের মুখে নিক্ষিপ্ত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষক কুলের যে চরম দুর্দশা হয়েছিলো তার কিঞ্চিৎ আভাস উপরে দেয়া হয়েছে।
একথারও উল্লেখ করা হয়েছে যে, জমিদার এবং প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে আরও দুটি স্তর বিরাজ করতো। যথা পত্তনীদার ও উপপত্তনীদার। জমিদারের প্রাপ্য খাজনার কয়েকগুণ বেশী এ দুই শ্রেণীর মাধ্যমে রায়তদের কাছ থেকে আদায় করা হতো এবং তাতে করে রায়ত বা কৃষকদের শোষণ-নিষ্পেষণের কোন সীমা থাকতো না।
জমিদার অর্থাৎ মুসলমানদের জমি আত্মসাৎকারী হিন্দু জমি দখলদার ও পত্তনীদারদের উৎপীড়নে মুসলিম কৃষক বিশেষ করে দরিদ্র, অসহায়, মিসকীন কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়তো। বাধ্য হয়ে এই শ্রেণীর কৃষকদেরকে হিন্দু বিত্তশীলদের দ্বারস্থ হতে হতো। শতকরা ৩৭ টাকা থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত হারে সুদে তাদেরকে টাকা কর্জ করতে হতো। উপরন্তু তাদের গরু/মহিষ হিন্দু দখলদারদের কাছে বন্ধক রাখতে হতো। অভাবের দরুণ হিন্দু জমি দখলদারদের কাছে অগ্রিম কোন শস্য গ্রহণ করতে হলে তার দ্বিগুণ পরিশোধ করতে হতো। আবার উৎপন্ন ফসল যেহেতু হিন্দুদের বাড়ীতেই তুলতে হতো, এখানেও তাদেরকে প্রতারিত করা হতো। মোটকথা হতভাগ্য মুসলিম কৃষকদের জীবন নিয়ে এসব জমি দখলদাররা ছিনিমিনি খেলে আনন্দ উপভোগ করতো। উল্লাস করতো। খুশি প্রকাশ করতো। নাঊযুবিল্লাহ!
কৃষকদের এহেন দুঃখ-দুর্দশার কোন প্রতিকারের উপায়ও ছিলো না। কারণ তা ছিলো অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। উপরন্তু জমি দখলদার ও তাদের দালালগণ উৎকোচ ও নানাবিধ দুর্নীতির মাধ্যমে খরচ কয়েকগুণে বাড়িয়ে দিতো। পরিণামে ফল এই দাঁড়ালো যে- মুসলমানদের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের ফলে অর্জিত যে সামান্য সহায়-সম্পত্তি, জমি, ভিটে-মাটিগুলো এই চরম ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী ব্রিটিশ বেনিয়া দস্যুগুলো এবং তাদের দালাল ও গোলাম উগ্র কাপুরুষ হিন্দু আরদালীগুলো চুষে চুষে খেয়ে ক্ষমতার মালিক বনে গেছে। যা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে জোর-জুলুম করে আত্মসাৎ করা।
এই ব্রিটিশ দস্যু ও তাদের আরদালী হিন্দু যবনগুলো মুসলমানদেরকে ভিটে-মাটি ও জমি-জমা থেকে উচ্ছেদ করে ভিখারীতে পরিণত করেছে। নাঊযুবিল্লাহ!
তারা সাধারণ মুসলমানদের মাল-সম্পদ জোর-জবরদস্তিমূলক দখল করে নিজেরা কথিত “জমিদার-মহাজন” সেজেছে। অথচ তারা মুসলমানদের গোলাম ছিলো।
-মুহম্মদ মুশফিকুর রহমান।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
ঐতিহাসিক স্থান ও যিয়ারতগাহসমূহ:
১৮ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (২০)
১৭ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ভারতের হায়দরাবাদ দখল করে রাখার চাপা ইতিহাস
১৫ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ১১)
১৩ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ১০)
১০ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (১৯)
১০ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ইসলামী বিশ্বকোষের আলোকে বালাকোট শহরের স্থাপত্য ও বালাকোট যুদ্ধের ইতিহাস (১)
০৯ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণে মুসলমানদের অবদান
০৮ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) -
বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ০৯)
০৬ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) -
বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ০৮)
০৩ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (১৮)
০৩ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
চলুন জানি: বিখ্যাত মুসলমান যুদ্ধাস্ত্র বিজ্ঞানী নাজমুদ্দিন হাসান আর রাম্মাহ’র কথা
০১ মে, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার)