বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ১০)
, ১২ যিলক্বদ শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ১২ ছানী আ’শার, ১৩৯২ শামসী সন , ১১ মে, ২০২৫ খ্রি:, ২৮ বৈশাখ, ১৪৩২ ফসলী সন, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) ইতিহাস
এই প্রসঙ্গে বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা (১৮০০-১৯০০) বইয়ের লেখক বিনয় ঘোষ (বুক ক্লাব প্রথম প্রকাশ বইমেলা ২০০০) ২৭-২৮ পৃষ্ঠায় প্রজাদের পীড়ন করার জন্য ১৮ দফা শাস্তির তালিকা প্রকাশ করে আরও বলে, বর্ণ হিন্দু জমি দখলদাররা ডাকাত লেঠেল ও গুন্ডা পোষে প্রজাদের পীড়ন করার জন্য। অবাধ্য ও বিদ্রোহী প্রজাদের ধান লুট করা, গরু-ছাগল হরণ করা, প্রজাদের পানিমগ্ন করা ও প্রহার করা তাদের প্রায় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। গ্রামের হিন্দু জমি দখলদাররা প্রজাদের উপর শুধু শারীরিক অত্যাচার যে কত রকমের করে, কলকাতার মতো শহরের অধিবাসীরা তা ঠিক জানে না বলে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা তার একটি ১৮ দফা তালিকা প্রকাশ করে-
১. দন্ডাঘাত ও বেত্রাঘাত।
২. চর্মপাদুকা প্রহার।
৩. বংশকাষ্ঠাদি দ্বারা বক্ষঃস্থল দলন।
৪. খাপরা দিয়ে কর্ণ ও নাসিকা মর্দণ।
৫. ভূমিতে নাসিকা ঘর্ষণ।
৬. পিঠে দুইহাত মোড়া দিয়ে বেঁধে বংশদন্ড দিয়ে মোচড় দেওয়া।
৭. গায়ে বিছুটি দেওয়া।
৮. হাত পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা।
৯. কান ধরে দৌড় করানো।
১০. কাঁটা দিয়ে হাত দলন করা। দুখানা কাঠের বাখারির একদিক বেঁধে তার মধ্যে হাত রেখে মর্দন করা। এই যন্ত্রটির নাম কাঁটা।
১১. গ্রীষ্মকালে প্রচ- রোদে ইটের উপরে পা ফাঁক করে দুহাতে ইট দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা।
১২. প্রবল শীতের সময় পানিতে চোবানো।
১৩. গোনীবদ্ধ করে পানিমগ্ন করা।
১৪. গাছে বা অন্যত্র বেঁধে টান দেওয়া।
১৫. ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে ধানের গোলায় পুরে রাখা।
১৬. চুনের ঘরে বন্ধ করে রাখা।
১৭. কারা রুদ্ধ করে উপবাসী রাখা।
১৮. ঘরের মধ্যে বন্ধ করে শুকনা মরিচের ধোঁয়া দেওয়া ইত্যাদি।
প্রজাপীড়নের এই ১৮ দফা ক্যাটালগও যথেষ্ট নয়, জমি দখলদারদের যথেষ্ট চারিতার সম্পূর্ণ চিত্র এর মধ্যেও ফুটে ওঠে না। উনিশ শতকের বাংলা সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠায় জমি দখলদারদের এই অত্যাচারের আরও অনেক মর্মস্পর্শী বিবরণ আছে। ...... চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদের গোত্রান্তরিত করেছিলো। পূর্বের ফিউডাল বদান্যতা এই জমি দখলদারদের ছিলো না। তারা স্বার্থপর অর্থপিশাচ হৃদয়হীন ঠিকাদারে পরিণত হয়ে ছিলো। যারা লুটেরা ব্রিটিশদের রাজস্বের ঠিকাদার। তার উপর বাংলাদেশে, মার্কস এর ভাষায় শহরের পুঁজিপতিরাই নিলামে জমিদারি কিনে গ্রাম অঞ্চলের জমিদারে পরিণত হয়ে ছিলো।
গ্রাম্য সমাজের সঙ্গে তাদের কোনো অন্তরের যোগ, নাড়ির যোগ ছিলো না। ব্রিটিশ আমলে বাংলার জমিদার শ্রেণীর এই গোত্রান্তর একটা বড় রকমের সামাজিক পরিবর্তন নয়া গ্রাম্য সমাজকে অনিবার্য ধ্বংসের মুখে এগিয়ে দিয়েছিলো।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলাদেশের কৃষক বইয়ের লেখক বিখ্যাত বামধারার গবেষক, বদরুদ্দীন উমর তার বইয়ের ২০ পৃষ্ঠায় শুধুমাত্র জমি দখলদারদের ১৮ প্রকার শাস্তিই নয় বরং গোমস্তা ও নায়েবদের অত্যাচারের কথাও উল্লেখ করেছেন।
১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের হাতে মুসলমানরা শুধু তাদের রাজ্য হারায়নি, হারিয়েছে তাদের সর্বস্ব। একদিন যাদের দরিদ্র হওয়া অসম্ভব ছিলো, সেই মুসলমানরা কাঠুরিয়া ও ভিস্তিওয়ালায় পরিণত হলো। [‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার। ] খোশরোজ কিতাব মহল, নতুন সংস্করণ।
জমি দখলদারদের নির্যাতন অত্যাচারের বিরুদ্ধে একসময় বাংলায় বিদ্রোহও শুরু করে মুসলিম কৃষকরা। ১৮৭২-৭৩ সালের সিরাজগঞ্জ ও পাবনার বিদ্রোহ ছিলো স্থানীয় জমি দখলদার কর্তৃক স্বেচ্ছাক্রমে খাজনা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলো হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ। এতে হিন্দু ও মুসলিম কৃষকরাও অংশগ্রহণ করেছিলো। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে পরিচালিত এ বিদ্রোহ ছিলো সীমিত সহিংস, বিক্ষিপ্ত এবং প্রাক-রাজনৈতিক চরিত্রের, কেননা জমিদারি প্রথা বিলোপ করা এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিলো না। তারা এসব জমি দখলদারের কাছে অন্যায্য খাজনা থেকে রেহাই চেয়েছিলো। ‘নৈতিক অর্থনীতি’র দৃষ্টিকোণ থেকে এদের অস্তিত্ব তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিলো না, যেহেতু সরকার সহিংস আন্দোলনের বিকল্প হিসেবে অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে ছিলো এবং কৃষকদের শান্ত করার উদ্দেশ্যে তাদের জন্য অধিকতর অধিকার নিশ্চিত করতে চেয়েছিলো এ বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে ১৮৮৫-এর বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন (ইবহমধষ ঞবহধহপু অপঃ, ১৮৮৫) কার্যকর করতে এবং শেষ পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (ওহফরধহ ঘধঃরড়হধষ ঈড়হমৎবংং) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বেশ ভূমিকা রাখে।
-মুহম্মদ মুশফিকুর রহমান।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কেমন ছিলো মোঘল সালতানাতের গোলন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
পান্থনিবাস ও সরাইখানা নির্মাণে মুসলমানদের অনবদ্য অবদান
২৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৯)
১৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার বিরোধিতায় বিধর্মী-অমুসলিমরা
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার হিন্দু ধনিক-বণিক, বেনিয়া শ্রেণী, ব্যাংকার প্রভৃতির সাথে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইউরোপকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন আফ্রিকান মুসলমানরা
১২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
গুজরাটের সুলতান মুজাফফর শাহের পরহেজগারিতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ
০২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৭)
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
কেমন ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ঐতিহাসিক মুসলিমবাগ ঈদগাহ-ই কি আজকের ঢাকেশ্বরী মন্দির?
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
১২টি চন্দ্রমাসের নাম এবং নামকরণের সার্থকতা (২)
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ঐতিহাসিক খেমকারান যুদ্ধ: যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের উদ্ভব
২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)












