বেপর্দা-বেহায়াপনায় আক্রান্ত কলুষিত সমাজের নতুন আতঙ্ক ‘সেলফি’। সেলফি উম্মাদনায় সমাজে ব্যাপকভাবে বেড়েছে হত্যা, আত্মহত্যা, সম্ভ্রমহরণ, সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা অপরাধ। বিভিন্ন দেশে সেলফি’র উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করলেও বাংলাদেশে কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সরকারের উচিত অপসংস্কৃতি এবং আত্মহত্যার মতো অপরাধ বন্ধ করতে অবিলম্বে সেলফি নিষিদ্ধ করা।
এডমিন, ২৮ ছফর শরীফ, ১৪৪৫ হিজরী সন, ১৬ রবি’ ১৩৯১ শামসী সন , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রি:, ৩০ ভাদ্র, ১৪৩০ ফসলী সন, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) মন্তব্য কলাম

গুগলের এক জরিপে জানা গেছে, সোস্যাল মিডিয়া পোস্ট করা সেলফির মধ্যে ৩৭% আপলোড করে থাকে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা। গুগলের পর্যালোচনায় দেখা যায়, উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে মোবাইল ফোনের অ্যাপসে যারা বিভিন্ন সোসাল মিডিয়ায় ৮ থেকে ১০ ঘন্টা কাটায় তারা গড়ে ১৪টি সেলফি পোস্ট করে থাকে। স্মার্টফোন এবং ক্যামেরা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্যামসাংয়ের জরিপ অনুযায়ী ১৮-২৪ বছর বয়সি মানুষের তোলা ছবির ৩০% ই সেলফি।
সেলফি শব্দটি ইংরেজি সেলফিশ থেকে এসেছে। সেলফি অর্থ প্রতিকৃতি। অক্সফোর্ড অভিধান মতে, “সেলফি হল একটি ছবি (আলোকচিত্র) যা নিজের তোলা নিজের প্রতিকৃতি, যা সাধারণত স্মার্টফোন বা ওয়েবক্যামে ধারণকৃত এবং যে কোনো সামাজিক মাধ্যমে আপলোড (তুলে দেয়া) করা হয় থাকে। ”
মানিকগঞ্জের মাঝারি ধরনের নাম ডাকওয়ালা একনেতা সম্প্রতি মৃত্যু বরণ করেছেন, নিকটাত্মীয় ও স্বজনরা লাশ খাটিয়ায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কবর স্থানে, চার পাশে লোকজনের কান্না আর দুরুদ শরিফ পাঠের আওয়াজ। হৃদয়বিদারক আর আহাজারিতে পুরো পরিবেশটাই ভারী। এরই মাঝে ক্লিক ক্লিক...দেখা গেল, খাটিয়া বহনকারী সামনের ভদ্রলোক স্মিত হাসিতে লাশ কাঁধে নিয়ে সেলফির উন্মাদনায় মক্ত।
দরিদ্র মানুষের মধ্যে সহায়তা প্রদান করতে ঢাকা থেকে এসেছেন একটি বড় রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা। নেতার আগমনে তার পাশে দাঁড়িয়ে, বসে, জড়িয়ে ধরে শুরু হয়ে যায় সেলফি তোলার মহা হুলস্থুল কা-। সময় গড়িয়ে যায় অনেক। সাহায্য নিতে আসা দরিদ্র মানুষগুলোর ক্লিষ্ট মুখাবয়বে ভেসে বেড়ায় কেবলই দীর্ঘশ্বাস।
শুধু এ দুই-চারটি ঘটনাই নয়, সেলফি জ্বরে আক্রান্ত গোটা দেশ।
নির্বাচন কেন্দ্রিক প্রচার-প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে সেলফি মাধ্যম। লাশ পাশে, উঁকি দিয়ে কবরখোদকদের সেলফি, রোগী দেখা হোক অথবা কোনো দুর্ঘটনা কিংবা অফিসে মিটিং চলাকালীন, কোরবানির পশুর সাথে, মাছ ধরে, কোথাও কিছু দান করতে গেলে সবচেয়ে আগে দরকার একটা সেলফি, পরে জিনিস দান হোক বা না হোক সেলফিটা আগে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে দিয়ে নিজের ফায়দা আদায় করতে কার্পণ্য করেন না অনেকেই। চলন্ত বাইকে, ট্রেনের ছাদে, পাহাড়ের চূড়ায়, ঝরনার পানিতে, হাঁটতে, চলতে এখন সেলফি তোলার নেশা। আর কোনো পিকনিক, ঐতিহাসিক স্থান, জনসভা, প্রাচীন স্থাপনার কাছে গেলে তো কথাই নেই, শত শত সেলফির বাহারি মেলা বসে যায়। সেলফি নেশা কখনো কখনো ডেকে আনছে ভয়াবহ বিপদ। অনেকের কাছে তাই সেলফি এখন আতঙ্ক।
বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ আজকাল স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সোস্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুকে ব্যস্ত সময় কাটান এবং এটি দিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকেন। প্রতিদিন দুই-চারটা সেলফি তোলা এখন আর ফ্যাশন নয়, রুটিন। নতুন চাকরি থেকে শুরু করে বিয়ে বাড়ি, মন খারাপ থেকে শুরু করে মন ভালো, নতুন জামা কেনা থেকে শুরু করে স্কুবা ডাইভিং সবখানেই সেলফি! শুরুতে সেলফি ব্যাপারটা মেয়েদের থাকলেও এখন ছেলেরাও পিছিয়ে নেই। কিন্তু মূলত এক ধরনের অবসেসিভ ডিসঅর্ডারের জেরেই এই সেলফি তোলেন মানুষ। এবং তা এমন পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে যে, বিপজ্জনক সেলফি তোলা থেকেও বিরত হচ্ছে না মানুষ। তাতে প্রাণও যাচ্ছে, তবু হুঁশ ফেরে না। এই সেলফি তোলার প্রবণতাকে অসুস্থতা হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের একদল গবেষক তাদের গবেষণা শেষে প্রকাশ করেছেন, সেলফি তোলা একটি মানসিক রোগ। এ গবেষক দল সেলফিতে আক্রান্ত হওয়া রোগের নাম দিয়েছেন সেলফাইটিস।
দেশের বড় বড় রাজনীতিবিদ, আমলা ও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে সেলফি তোলা যেন দিন দিন নিয়মে পরিণত হচ্ছে। অসাধু ব্যক্তিরা। নেতাদের সাথে সেলফি হলে পরে সেই ছবি দেয়ালে সাঁটিয়ে নিজেকে ঘনিষ্ঠজন পরিচয় দিয়ে হরহামেশাই নানাবিধ অপকর্ম ও দুর্নীতি করে যাচ্ছে। আর এ নিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হয় সেই সব নামকরা রাজনীতিবিদ, আমলা ও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাসিনো অভিযান, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে পরিচালিত অভিযানে এমনটি লক্ষ করা গেছে। এসবের দায় নেবে কে?
সেলফি’র কারণে কেউ গাড়ি চালানোর সময়, কেউ এগিয়ে আসা ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে মারা যাচ্ছে। পাইলট বিমান চালানোর সময় নিজের সেলফি তুলে যাত্রীসহ মারা যাচ্ছে, নিজেকে দুঃসাহসী প্রমাণ করতে কেউ উন্মত্ত ষাঁড়ের সাথে, কেউ ভাল্লুকের সাথে, কেউ সিংহের সাথে নিজের ছবি তুলতে গিয়ে হিং¯্র প্রাণীর হাতে জীবন দিচ্ছে। কেউ পিস্তল হাতে সেলফি তুলতে গিয়ে নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে দিচ্ছে, কেউ ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে নদীতে পড়ে মারা যাচ্ছে। শুধু তাই নয় পবিত্র হজ্জ এবং ওমরাহ করতে গিয়েও অনেকে পবিত্র ক্বাবা শরিফ, পবিত্র মদীনা শরীফ উনাদেরকে পেছনে রেখে সেলফি তুলছে। আবার তা ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। নাউযুবিল্লাহ!
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশেও সেলফি তুলতে গিয়ে নিহত হচ্ছে অনেকে। কিছুদিন আগে চাচার সাথে যমুনা নদীর তীরে হাটার সময় সেলফি তুলতে গিয়ে নদীতে পড়ে তলিয়ে যায় এক যুবক। সম্প্রতি হাতিরঝিলে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে এক যুবক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়। গত পহেলা ফেব্রুয়ারী বাসর ঘরে সেলফি তোলার কারণে সিদ্বেশ্বরী কলেজের ছাত্রীর সাথে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে এলাকার তরুন ব্যবসায়ী। সেলফি’র মরণ থাবা এখন বাংলাদেশে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। কিন্তু দেশের তরুণ-তরুনীদের রক্ষায় কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
অথচ ভারতের মুম্বাইয়ে ১৬টি এলাকায় নো সেলফি জোন ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ এ স্থানগুলোতে সেলফি তোলা নিষিদ্ধ। সম্প্রতি মুম্বইয়ের বান্দ্রায় সমুদ্র সৈকতে সেলফি তুলতে গিয়ে তলিয়ে যায় তিন কলেজ ছাত্রী। এরপর এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দাদর, জুহু, বান্দ্রা বাসস্ট্যান্ডসহ ১৬টি সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাকে হাই-রিস্ক এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এসব স্থানে সেলফি না তোলার সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনকি বাড়ানো হয়েছে পুলিশি নিরাপত্তা। নো সেলফি জোনে সেলফি তুললে জরিমানা গুনতে হবে ১২০০ রুপি। মুম্বাই পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিপজ্জনক এসব এলাকায় ভ্রমণকারীদের ছবি তোলার উপর নিষেধাজ্ঞা আছে। তাছাড়া সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের কুম্ভমেলায় সেলফি তোলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চীনের রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের সম্মেলনে ‘সেলফি স্টিক’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব্রিটেনে ভোট দেয়ার পর নির্বাচনী কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে সেলফি তুললে নির্বাচনী কর্মকর্তা যদি পাঁচ হাজার পাউন্ড জরিমানা অথবা ছয়মাসের জেলের বিধানও রয়েছে।
উল্লেখ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেলফি’র উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করলেও বাংলাদেশে কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সরকারের উচিত অপসংস্কৃতি এবং আত্মহত্যার মতো অপরাধ বন্ধ করতে অবিলম্বে সেলফি নিষিদ্ধ করা।
-আল্লামা মুহম্মদ ওয়ালীউর রহমান।