স্থাপত্য-নিদর্শন
বয়নশিল্প নিদর্শনে মুসলমানগণ (২)
, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১২:০০:০০ এএম ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) স্থাপত্য নিদর্শন
সেলযুক গালিচা ও বয়নশিল্প:
তুর্কিস্তানের কিরগিজ পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেলযুক সেনাপতির নেতৃত্বে ঘোজ যাযাবর তুর্কিদের পারস্য ও মধ্য এশিয়ার ভূমিতে দশম শতাব্দীতে (৯৫৬ খৃ:) আগমন রাজনীতি এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সাধন করেছিলো। প্রথমে তারা বুখারায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে এবং পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনার মতাদর্শ গ্রহণ করেন। ক্রমান্বয়ে উনারা সমগ্র ইরাক ও পারস্যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করে তুঘরিল বেগের নেতৃত্বে ১০৫৫ খৃ: এর দিকে আব্বাসীয় সালতানাতের রাজধানী বাগদাদে উপনীত হয়ে আল-কাইয়ুমকে (১০৩১-১০৭৫ খৃ:) বুয়াইয়াশিয়ার কবল থেকে মুক্ত করে বুয়াইয়া বংশের পতন ঘটায় এবং সুন্নী ইসলাম উনার শক্তি বৃদ্ধি করেন। পারস্য ও মধ্য এশিয়ায় সেলযুক শক্তি ১১৫৭ খৃ: পর্যন্ত এবং রোমের আইকোনিয়ামে উনাদের আরো একটি শক্তিশালী দল ১৩০০ খৃ: পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় আধিপত্য বজায় রাখেন।
শিক্ষা ও শিল্পের বিভিন্ন শাখার ন্যায় সেলযুক তুর্কিগণ বয়নশিল্পের অগ্রগতি ও বিকাশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বুননবস্ত্রের মধ্যে গ্রন্থীযুক্ত গালিচা প্রস্তুত সেলযুক বয়নশিল্পীদের পারদর্শিতার সাক্ষ্য বহন করে। পারস্যে গ্রন্থী প্রয়োগ পদ্ধতিতে তাদের গালিচা তৈরির যাত্রা শুরু হলেও এশিয়া মাইনরে এরূপ গালিচার বিদ্যমানতা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। কারণ সুলতান আলাউদ্দীন কুনিয়ার মসজিদে এরূপ কয়েকটি গালিচা ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় এবং সেগুলো এখন তুর্কি ও ইসলামি শিল্পের ইস্তাম্বুলের মিউজিয়ামে বিশেষ বয়ন নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে পরবর্তী ৩২৭ বৈশিষ্ট্যাবলির বিকাশ প্রত্যক্ষ করা যায়। গ্রন্থী প্রয়োগ পদ্ধতিতে তৈরি এরূপ গালিচার ক্ষেত্র ও প্রান্তসীমার মধ্যে বিরাট পার্থক্যের তুলনা বিচার্য।
গালিচার অবকাঠামো ধারণ করে চলমান জ্যামিতিক প্যাটার্ন অথবা ক্ষুদ্রাকায় বহুভুজক্ষেত্র যা গোটা অবয়বে নিয়মিত সারিতে পুনঃপুনঃ উপস্থাপিত। আর প্রান্তসীমা কুফিক লিখনশৈলীতে অর্থবোধক কিংবা অর্থহীন লিপিতে খচিত। গ্রন্থীকরণ অমসৃণ হওয়া সত্ত্বেও রঙের সংমিশ্রণ ও ব্যবহার অত্যন্ত দীপ্তিময়। এরূপ সাধারণ সূচনা থেকে পরবর্তীতে আনাতোলীয় গ্রন্থীযুক্ত গালিচার চরম বিকাশ ঘটেছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে বুয়াইয়া শাসকদের প্রচেষ্টায় দশম ও একাদশ শতাব্দীতে বাগদাদে সিল্ক বা রেশম শিল্পের প্রভূত উন্নতি হয় এবং পরবর্তীতে সেলযুকদের সময়ে বাগদাদসহ দেশের অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন প্রকার ও ধরনের বস্ত্রাদি তৈরি হতো যা প্রাচ্যের অন্যান্য দেশসমূহে রপ্তানি করা হতো। পাশ্চাত্যে প্রচলিত বালদাচিন (বাগদাদ-উপকরণ) ও মুসলিন সেসময় প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সুসম বাণিজ্যের চিত্র তুলে ধরে। মিশরের তিরায কারখানায় উৎপাদিত বস্ত্রাদির পরিপূরক হিসেবে এগুলো বিবেচিত হয়ে থাকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পাশ্চাত্যের বাজারে পালেরমো তাঁতবস্ত্রের সাথে ইরাকে উৎপাদিত দুই রং বিশিষ্ট সিল্ক বস্ত্রাদির প্রতিযোগিতা করতে হতো। এই অলঙ্করণ মটিফ সাধারণত প্রত্যক্ষ করা যায় সারিতে বিন্যাসিত ভিন্নমুখী দু’টি সিল্কবস্ত্রের উদাহরণে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ওরতোকিড রীতিতে। উত্তর মেসোপটেমিয়ায় এসবের উৎপত্তিস্থল নির্দেশ করা যায়। উপরন্তু সেলযুকদের সময়পর্বে গোটা পারস্যে বয়নশিল্পের উন্নত কারখানা চলমান ছিলো।
মামলুক আমলের বয়নশিল্প ও সুন্দর সূচিকর্ম (ত্রয়োদশ-ষষ্ঠদশ শতাব্দী) ফাতেমীয় যুগের পর মামলুকদের আমলে (১২৫০-১৫১৭) তিরায বয়নবস্ত্রের আর তেমন প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় না। লিনেনের ওপর সিল্ক ট্যাপিস্ট্রি (জাঁকালো রেশমী কাপড়ের বিশেষ পর্দা) বুননের প্রক্রিয়া অনেকটা বন্ধ হয়ে যায় এবং তদস্থলে চৈনিক বয়নবস্ত্রের অনুকরণে নতুন ধরনের সিল্কবস্ত্র তৈরির কৌশল চালু হয় এবং তা মোঙ্গল যুগের কাপড় বুননের রীতি স্মরণ করিয়ে দেয়। মামলুকদের আমলে মোঙ্গল ও পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোর সাথে মিশরের বাণিজ্য সম্পর্ক বেশী আন্তরিক হয়ে ওঠে এবং বুটিতোলা রেশমীবস্ত্র ও কিংখাব মিশর থেকে সে দেশগুলোতে রপ্তানি করা হতো।
প্রাচ্যের সাথে সাথে পাশ্চাত্যের দেশসমূহে মিশরের স্বর্ণবুটিতোলা রেশমীবস্ত্র আদৃত হতে দেখা যায়। মুসলমানদের এরকম ঐতিহ্যমন্ডিত শিল্পের এরূপ জাঁকালো বুটিতোলা পাশ্চাত্যের বিধর্মীদের অনেক কোষাগারে সংরক্ষিত আছে। সম সাময়িককালের (চতুর্দশ শতাব্দী) পারসিক বুননবস্ত্রের সাথে মামলুক যুগের তদ্ভবস্ত্রের বহুলাংশে মিল থাকলেও পুষ্পাদি উপস্থাপনে দূরপ্রাচ্যের রীতি অনুসরণ করে শিল্পীগণ তাতে মামলুক বিশিষ্টতা দান করেছেন। মিশরে প্রস্তুত লাল বুটিদার কাপড়ে বিদেশি বৈশিষ্ট্যের ছাপ লক্ষ্য করা যায় এবং এই জাতীয় তন্ত্রবস্ত্র ইউরোপে রপ্তানি করা হতো। তরঙ্গায়িত স্ক্রোল, পদ্মসদৃশ প্যামেট ও পরস্পরের সাথে বুনন প্রভৃতি কৌশল এবং এই মটিফগুলো কিভাবে মামলুক আলঙ্কারিক শিল্পে অনুপ্রবেশ করেছে তার পন্থাও নির্দেশ করা হয়েছে। এছাড়া বিভক্ত পরিসরে উপস্থাপিত বিবাদমান বহু রংয়ের তন্ত্রবস্ত্র ও হালকা সিল্ক কাপড় মিশরে প্রস্তুত সমকালীন বয়নশিল্পের প্রতিনিধিত্ব করে। কারণ এগুলোর প্রান্তে আরবী লিপিমালায় তারিখ উল্লেখিত হয়েছে। (অসমাপ্ত)
-মুহম্মদ নাইম।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণে মুসলমানদের অবদান
২৩ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
মালয়েশিয়ার ঐতিহাসিক মসজিদ “মসজিদ নেগারা”
১৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
যে মসজিদ থেকে গভীর রাতে ভেসে আসতো যিকিরের আওয়াজ
০৯ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৮)
০৮ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সাইয়্যিদ হযরত শাহ মখদুম রুপোশ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাজার শরীফ
০২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
বয়নশিল্প নিদর্শনে মুসলমানগণ (৬)
২৬ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
বয়নশিল্প নিদর্শনে মুসলমানগণ (৫)
১৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
বয়নশিল্প নিদর্শনে মুসলমানগণ (৪)
১২ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
বয়নশিল্প নিদর্শনে মুসলমানগণ (৩)
০৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
স্থাপত্যশৈলীর অনন্য স্থাপনা মানিকগঞ্জের ‘ওয়াসি মহল’
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
বয়নশিল্প নিদর্শনে মুসলমানগণ (১)
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
মুসলমানদের শিল্পকলার এক অনন্য নিদর্শন ইসলামী মৃৎপাত্র (১১)
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার)












