বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ০২)
, ১৮ শাওওয়াল শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ১৮ হাদি আশির, ১৩৯২ শামসী সন , ১৭ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রি:, ৪ বৈশাখ, ১৪৩২ ফসলী সন, ইয়াওমুল খমীছ (বৃহস্পতিবার) ইতিহাস
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ইংরেজদের লুটপাটের জন্য ধারণাতীত সাফল্য বয়ে এনেছিলো। ইংরেজদের ওপর চরম আক্রোশ নিয়ে বাংলাদেশের নির্যাতিত কৃষকরা যখন যুদ্ধরত, ‘মুসলমান মাত্রই রাণীর বিদ্রোহী প্রজা’- রূপে চিহ্নিত করা হতো। আর অপরদিকে কলকাতার সদ্য বিকশিত উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের এই শ্রেণীটি প্রকাশ্যে ইংরেজদের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণার মাধ্যমে প্রভুর শক্তি বৃদ্ধি করেছিলো-
ইংরেজ অর্থাৎ ব্রিটিশদের চরম দুর্দিনে ১৮৯৮ সালের ২১ আগস্ট বাংলার জমিদারগোষ্ঠীর প্রতিভূরূপে কোলকাতার হিন্দু শ্রেণীর সেরা ধনী দাবিদারদের একাংশ এক সভা অনুষ্ঠান করে ব্রিটিশ রাজ্যের প্রতি তাদের আনুগত্যের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে। (সিলেকশন ফ্রম ক্যালকাটা গেজেটস, ভল্যুম-৩, ডব্লিউ এস সিটনকার, ৫২৫ পৃষ্ঠা, উদ্ধৃত স্বপন বসু: বাংলার নব চেতনার ইতিহাস, ১৮৩ পৃষ্ঠা)
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর হইতে কোলকাতার বর্ণহিন্দু অভিজাত শ্রেণীটির আত্মপ্রতিষ্ঠার সে বাস্তব চিত্র বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণীতে পাওয়া যায় তা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। সুপ্রকাশ রায় এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করেছে। সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কোলকাতা-চিৎপুর-বিরাজি-চক্রবেড়ি গ্রামগুলির ধানক্ষেত ও কলাবাগানের ভিতর থেকে টাউন কোলকাতার দ্রুত বেড়ে ওঠার কারণ এবং ইংরেজদের দ্বারা নব্য-সৃষ্ঠ শ্রেণীটির অবাক উত্থানের কারণ সম্পর্কে এই বিবরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়।
সুপ্রকাশ রায় লিখেছে- “বঙ্গদেশে ইংরেজ বণিকগণের মুৎসদ্দিগিরি, লবণের ইজারা, প্রভৃতির মারফত যাহারা প্রভূত ধন-সম্পদ আহরণ করিয়াছিলো, তাহারা এবং মারক্সের ভাষায় ‘শহরের চতুর ফড়িয়া ব্যবসায়ীগণ’ ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর হইতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের মধ্যে.. নতুন জমিদার শ্রেণীরূপে আবির্ভূত হইয়াছিলো।
এই নতুন জমিদার শ্রেণীটির বৈশিষ্ট্য ছিলো- ইংরেজ শাসকগণের প্রতি অচলা ভক্তি এবং কৃষির ক্ষেত্র হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া শহরে অবস্থিত, গ্রামাঞ্চলের ভূ-সম্পত্তি হইতে ইজারা মারফত অনায়াস-লব্ধ অর্থবিলাস-ব্যসনে জীবন যাপন এবং ‘বেনিয়ান’ লবণের ইজারাদার প্রভৃতি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বগ্রাসী ব্যবসার সহিত ঘনিষ্ট সহযোগিতা। ইংরেজ-সৃষ্ট এই নতুন বিত্তশালী জমিদার শ্রেণীটি আবির্ভূত হয়।
দ্বারাকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় প্রভৃতি ছিলো এই অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে অগ্রগণ্য। .. সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপী যখন বাংলার তথা ভারতের কৃষক প্রাণপণে ইংরেজ শাসন ও জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতেছিলো, তখন (এই শ্রেণীটি) সংগ্রামরত কৃষকের সহিত যোগদানের পরিবর্তে বিদেশী ইংরেজ শাসনকে রক্ষা করিবার জন্য কৃষকের সহিত ধনবল ও জনবল নিয়োগ করিয়াছিলো”। (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম, ১৮৬-১৮৯ পৃষ্ঠা)
১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ভূমি পরিণত হলো পণ্যে। বহু বনেদী পরিবার রাতারাতি হলো পথের ভিখারী। অন্যদিকে ব্রিটিশ বেনিয়াদের পূজা-আর্চনা করে দেওয়ান-বেনিয়ান-মুৎসুদ্দী গোমস্তা শ্রেণীর নিকৃষ্ট জাতগুলো জমিদারী কিনে হলো সামন্ত-অভিজাত। ১৮২৯ সালে বাজেয়াপ্ত হলো লাখোরাজ সম্পত্তি।
এই সব নিষ্কর জমির আয়ে পরিচালিত মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দাতব্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলো। সব দিক থেকেই নেমে এলো অন্ধকার। এরপর এলো রাজ-ভাষার ওপর আঘাত। ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি হলো অফিস-আদালতের ভাষা। হিন্দুরা নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিলো পুরোনো নিয়মে।
কিন্তু লুণ্ঠিত, বঞ্চিত, অবদমিত, ক্ষুব্ধ, হতাশা-বিহ্বল, অভিমানাহত মুসলমানরা তখন সারা দেশে সুযোগ পেলেই ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জিহাদরত। বাঙালি হিন্দু ঘরের ছেলেরা যখন ইংরেজি শেখার জন্য হেয়ার এর পাল্কির সঙ্গে দৌঁড়াচ্ছে। তখনকার মুসলমান মাত্রই ছিলো ক্যানিং-এর ভাষায়- ‘মহারানীর বিদ্রোহী প্রজা’।
কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু নব্য বিকশিত বাবু শ্রেণী যখন ক্লাইভকে পূজা করছে, পল্লী বাংলায় জনগণের মধ্যে তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্রমে পুঞ্জিভূত হচ্ছিলো চাপা ক্ষোভ আর ঘৃণা। রামেশচন্দ্র দত্ত লিখেছে- “সারা বাংলায় ইংরেজদের অখ্যাতি এমন রটেছিলো যে, একজন ইংরেজ কোন গ্রামে এলে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেতো, জনসাধারণও নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পালিয়ে বাঁচতো”। (দি ইকনোমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, ১১২ পৃষ্ঠা)
১৭৯৩ সালে কর্নওয়ালিস প্রশাসন কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও বাংলার জমি মালিকদের (সকল শ্রেণীর জমিদার ও স্বতন্ত্র তালুকদারদের) মধ্যে সম্পাদিত একটি যুগান্তকারী চুক্তির নাম। এই চুক্তির আওতায় জমিদার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হয়। জমির স্বত্বাধিকারী হওয়া ছাড়াও জমিদারগণ স্বত্বাধিকারের সুবিধার সাথে চিরস্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় এক নির্ধারিত হারের রাজস্বে জমিদারিস্বত্ব লাভ করে। চুক্তির আওতায় জমিদারদের কাছে সরকারের রাজস্ব-দাবি বৃদ্ধির পথ রুদ্ধ হয়ে গেলেও জমিদারদের তরফ থেকে প্রজাদের ওপর রাজস্বের দাবি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি। জমিদারদের জমি বিক্রয়, বন্ধক, দান ইত্যাদি উপায়ে অবাধে হস্তান্তরের অধিকার থাকলেও তাদের প্রজা বা রায়তদের সে অধিকার দেওয়া হয়নি। নিয়মিত খাজনা পরিশোধ সাপেক্ষে উত্তরাধিকারক্রমে জমির মালিক থাকার প্রথাগত অধিকার রায়তদের বা কৃষকদের থাকলেও জমি হস্তান্তরের অধিকার তাদের ছিলো না। সরকারের বেলায় জমিদারদের অবশ্য একটি দায়দায়িত্ব কঠোরভাবে পালনীয় ছিলো। সেটি হচ্ছে নিয়মিত সরকারের রাজস্ব দাবি পরিশোধ করা।
-মুহম্মদ মুশফিকুর রহমান।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কেমন ছিলো মোঘল সালতানাতের গোলন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
পান্থনিবাস ও সরাইখানা নির্মাণে মুসলমানদের অনবদ্য অবদান
২৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৯)
১৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার বিরোধিতায় বিধর্মী-অমুসলিমরা
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার হিন্দু ধনিক-বণিক, বেনিয়া শ্রেণী, ব্যাংকার প্রভৃতির সাথে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইউরোপকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন আফ্রিকান মুসলমানরা
১২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
গুজরাটের সুলতান মুজাফফর শাহের পরহেজগারিতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ
০২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৭)
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
কেমন ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ঐতিহাসিক মুসলিমবাগ ঈদগাহ-ই কি আজকের ঢাকেশ্বরী মন্দির?
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
১২টি চন্দ্রমাসের নাম এবং নামকরণের সার্থকতা (২)
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ঐতিহাসিক খেমকারান যুদ্ধ: যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের উদ্ভব
২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)












