খাবারের নামে আমরা কী খাচ্ছি? ভেজাল খাবারে দেশব্যাপী চলছে নীরব গণহত্যা। ভেজাল দমনে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
এডমিন, ০৩ রবীউল আউওয়াল শরীফ, ১৪৪৫ হিজরী সন, ২১ রবি’ ১৩৯১ শামসী সন , ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রি:, ০৪ আশ্বিন, ১৪৩০ ফসলী সন, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) মন্তব্য কলাম
দেশে দূষিত খাবারের ব্যাপ্তি কী পরিমাণে বাড়ছে পরিসংখ্যানেই তার প্রমাণ মিলছে। এছাড়া একাধিক গবেষণায় বারবার খাবারের ভেজালের বিষয়টি উঠে এসেছে।
লেখাবাহুল্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য ভেজাল খাদ্যকে দায়ী করা হচ্ছে। থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ককে বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞের মতে, হাসপাতালের রোগীদের অর্ধেকই বাংলাদেশের। এদের মধ্যে বেশির ভাগ কিডনি, লিভার ও প্রজনন সমস্যায় ভুগছে।
উল্লেখ্য, জমি থেকে ফসল তোলা থেকে শুরু করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করণের জন্য প্রস্তুত ফ্যাক্টরীগুলোতেও মেশানো হচ্ছে ভেজাল। ভেজালেরও ধরণ রয়েছে ভিন্ন। যে খাদ্যে যে ধরনের ভেজাল মেশালে সহজে চোখে ধরা পড়ার কোনো সুযোগ নেই সেদিকেই নজর রাখা হচ্ছে চক্রন্তিকারীরা। শুঁটকি আড়তে প্রকাশ্যেই কীটনাশক মেশানো হচ্ছে। ভোজাল খাদ্য থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য সরকারি উদ্যোগ নেই বললেই চলে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তা সাধারণ।
সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারেই বেকারি পণ্যে দুনিয়ার ভেজাল। ফলে মাছে ফরমালিন। অপরিপক্ক টমেটো হরমোন দিয়ে পাকানো হচ্ছে। গরুকে নিষিদ্ধ ঔষধ খাইয়ে মোটা করা হচ্ছে। সেগুলো মানব স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর! পচনরোধে বিষাক্ত ফরমালিন, তাজা দেখাতে মাছে রেড অক্সাইড, ফলমূল ও শাক-সব্জিতে কার্বাইড মিশানো হয়ে থাকে। এসব রাসায়নিক পদার্থ মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মানুষের লিভার, কিডনি নষ্ট করে ফেলে। মানুষ তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অসুস্থ হয়ে নিতে হয় হাসপাতালে। যে দেশে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সেখানে রোগ বালাই যেন গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো। বিকল্পহীন এ সব ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নানা রকম ক্রনিক রোগে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশবাসী আর কত ভেজাল খাবে? কথায় বলে, মাছে-ভাতে বাঙালি। সেই মাছ-ভাত এখন আর নিরাপদ নেই। মাছে ও দুধে ফরমালিন, চালে আর্সেনিক, ফলমূলে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল, সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক, জিলাপি-চানাচুরে মবিল, বিস্কুট, আইসক্রিম, কোল্ডড্রিংক্স, জুস, সেমাই, আচার, নুডুলস এবং মিষ্টিতে টেক্সটাইল ও লেদার রং, মুড়িতে ইউরিয়া-হাইড্রোজ, ক্যাডমিয়াম, লেড, ইকোলাই।
ভেজাল খাবার খেয়ে জাতি ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছে, নতুন প্রজন্ম মেধাহীন পঙ্গু জীবনের মতো এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আগাচ্ছে। কোথায় নেই ভেজাল? সবকিছুতেই ভেজাল। নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে ভেজাল ও নকল পণ্য। সেই পণ্য চলে আসছে বাজারে। আসল পণ্যের হুবহু নকল সিল-মনোগ্রাম, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন না নিয়ে নকল অনুমোদনপত্র ছাপা হয়ে যাচ্ছে প্যাকেটের গায়ে। নকলের দাপটে এখন আসল পণ্য চেনাই দায় হয়ে পড়েছে। বাজার সয়লাব হয়ে গেছে এসব নকল পণ্যে।
ফরমালিন মেশানো খাবার ধরা পড়লে জেল-জরিমানাও করা হচ্ছে, তারপরও থেমে নেই তারা। জীবন রক্ষাকারী খাবার স্যালাইন নকল তৈরি হচ্ছে। এমনকি খেজুরেও ফরমালিন দেয়া হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর-নোংরা পরিবেশে কোনো ধরনের ল্যাবরেটরি ও রসায়নবিদ ছাড়াই স্যালাইনের মতো অতি জরুরী একটি ওষুধ তৈরি করে বাজারজাত করা হচ্ছে। কাউন ও কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে মসলা তৈরি করা হয়। ঘাসের গুঁড়ার সঙ্গে রং মিশিয়ে নামি-দামী ব্র্যান্ডের মসলা তৈরি করে একটি চক্র। ছোলা ও মুড়ি সাদা করতে মেশানো হয় হাইড্রোজ। কৃত্রিম রং মিশিয়ে নকল ঘি বানানো হচ্ছে। এমনকি শিশুদের বিকল্প খাদ্যেও মেলামিন (ভেজাল) মেশানো হচ্ছে। আম, আনারস ও টমেটোতে কেমিক্যাল মিশিয়ে হলুদ করা হচ্ছে। এমনিভাবে দেশের প্রতিটি খাবারেই ভেজাল মেশানো হচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল হিসেবে জুতার কালি ও কাপড়ের রংও উদ্ধার করেছে বিভিন্ন অভিযানের সময় মোবাইল কোর্ট।
বিষাক্ত সাইক্লোমেট দিয়ে তৈরি হচ্ছে টোস্ট বিস্কুটসহ বিভিন্ন রকমের ফাস্টফুড এবং বিষাক্ত উপকরণ দিয়ে তৈরি রুটি, বিস্কুট, সেমাই, নুডলস হচ্ছে। মবিল দিয়ে ভাজা হচ্ছে চানাচুর।
তাছাড়া কৃত্রিমভাবে প্রজননের মাধ্যমে বাজারজাত মাছ, গোশত আমরা সবসময় খাই। মাছকে ইউরিয়া সার খাওয়ানো হয় এবং গরুর বর্জ্য, চামড়া আগুনে পুড়িয়ে এক প্রকার খাদ্য বানিয়েও মাছকে খাওয়ানো হয়, এমনকি ফার্মের বয়লার মুরগির বর্জ্য খাওয়ানো হয়। গরুকে বলিষ্ঠ করার জন্য আখের গুড়ের তৈরির বর্জ্য (রাব) যা এলকোহলসমৃদ্ধ এবং এমনকি ইউরিয়া মিশ্রিত ঘাস ও খড় খাওয়ানো হয়। এসব রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাবার যে গরু খায় সে গরুর গোশত আমরা খাই। কিন্তু এসব নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ব্যার্থতা কোনোভাবেই বরদাশতযোগ্য নয়।
প্রসঙ্গত আমরা মনে করি যে, শুধু আইনের বল প্রয়োগেই এ ভেজাল প্রবণতা রোধ করা যাবে না। কারণ মানুষের তেরি আইনের গোলকধাঁধাঁয় মানুষ সহজেই পার পেয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় হলো- মানুষের সৃষ্টিকর্তা খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি অনুগত হওয়া ও উনার ভয় লালন করা এবং এ সম্পর্কিত মূল্যবোধ ও চেতনা জাগ্রত করা।
মূলত, এসব অনুভূতি ও দায়িত্ববোধ আসে পবিত্র সাইয়্যিদু সাইয়্যিদিল আ’ইয়াদ শরীফ অনন্তকালব্যাপী পালন করার ইলম ও জজবা থেকে। আর তার জন্য চাই নেক ছোহবত তথা মুবারক ফয়েয-তাওয়াজ্জুহ।
-আল্লামা মুহম্মদ ওয়ালীউর রহমান।