স্থাপত্য-নিদর্শন
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঐতিহাসিক শাহ নিয়ামতউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি মসজিদ
, ১৯ জুমাদাল উলা শরীফ, ১৪৪৫ হিজরী সন, ০৫ সাবি’ ১৩৯১ শামসী সন , ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রি:, ১৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ ফসলী সন, ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) স্থাপত্য নিদর্শন
শাহ নিয়ামতউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি মসজিদ মুঘল যুগের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন ও অন্যতম প্রাচীন মসজিদ বলে বিবেচনা করা হয়। এই ঐতিহাসিক মসজিদটি বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অধীনে পড়েছে। ছোট সোনামসজিদ থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরেই রয়েছে তাহাখানা কমপ্লেক্স, সঙ্গে রয়েছে একটি মসজিদ, প্রাসাদ ও শাহ নিয়ামতউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাজার শরীফ। তাহাখানার মূল প্রাসাদ থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে সামান্য দূরে রয়েছে শাহ নিয়ামতউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি মসজিদ।
ধারণা করা হয় সুবাহদার শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৬০ খৃ:) সুফি-সাধক শাহ নিয়ামতউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সম্মানার্থে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।
ইতিহাস:
শাহ সুজা বাংলার সুবেদার মোঘল শাসক শাহজাহানের দ্বিতীয় ছেলে। তিনি ১৬৩৯ থেকে ১৬৬০ খৃ: পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। স্থাপত্যকর্মের প্রতি উনার বিশেষ অনুরাগ ছিল। উনার সময়ে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল। তন্মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনাটি হলো বড় কাটরা। এছাড়াও লালবাগ মসজিদ ও শাহী ঈদগাহ (ধানমন্ডি) তৈরি করা হয়েছিল। এ ছাড়া কুমিল্লায় রয়েছে শাহ সুজা মসজিদ। উনার সময়ে নির্মাণ করা হয় বড় কাটরা, হোসেনী দালান, ঈদগাহ ও চুড়িহাট্টা মসজিদ। শাহ সুজা রাজমহলে একটি প্রাসাদ (সাঙ্গ-ই-দালান) ও মসজিদ তৈরি করেছিলেন।
শাহ নিয়ামতউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি হলেন মধ্যযুগের একজন প্রখ্যাত দ্বীন প্রচারক। তিনি তৎকালীন জান্নাতবাদে (চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্থান) পবিত্র দ্বীন ইসলাম প্রচার করতেন। উনার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন পবিত্র মক্কা শরীফের বনু আসাদ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র দ্বীন ইসলাম প্রচারের জন্য উনারা ভারতবর্ষে আগমন করেন। তিনি সুলতান শাহ সুজার সময়ে দিল্লীর “করোনিয়ার” নামক স্থান থেকে রাজমহলে আসেন পবিত্র দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে। শাহ সুজা উনাকে অভ্যর্থনা জানান এবং উনার নিকট বাইআত গ্রহণ করেন।
পরবর্তীতে তিনি জান্নাতবাদের উপকন্ঠে (বর্তমানে ফিরোজপুরের) স্থায়ীভাবে খানকা স্থাপন করেছিলেন। এই অঞ্চলে তিনি দীর্ঘদিন যাবত সুনামের সঙ্গে পবিত্র দ্বীন ইসলাম প্রচার করেন। ফিরোজপুরেই ১৬৬৪/১৬৬৯ খৃ: উনি ইন্তেকাল করলে উনার মাজার শরীফ সেখানেই স্থাপিত হয়।
শাহ সুজা উনার স্বীয় শায়েখ শাহ নিয়ামতউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বসবাসের জন্য সেখানে ছোটসোনা মসজিদের পাশেই খানকাহ ও দৃষ্টিনন্দন তোহাখানা নির্মাণ করেন। পরে তিনি জান্নাতবাদের উপকন্ঠে ফিরোজপুরে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় ৩৫ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত শাহাবাজপুর ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী তোহাখানা কমপ্লেক্স এর অভ্যন্তরে শাহ নিয়ামতউল্লাহ এর তিন গম্বুজ মসজিদের উত্তরে শাহ নিয়ামতউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাজার শরীফ অবস্থিত। তোহাখানা এর উদ্দেশ্যে শীতকালীন বাসের জন্য তাপনিয়ন্ত্রণ ইমারত হিসেবে তোহাখানা নির্মাণ করেছিলেন। তোহাখানা ফার্সি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ ঠান্ডা ভবন বা প্রাসাদ। সময়ে সময়ে শাহ সুজাও স্বীয় মুর্শিদ উনার ছোহবতে এসে এখানেই থাকতেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ হতে জানা যায়, শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা বাংলার সুবেদার থাকাকালে ১৬৩৯-১৬৫৮ খৃ: মতান্তরে ১৬৩৯-১৬৬০ খৃ: উনার স্বীয় মুর্শিদ শাহ নিয়ামতউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার প্রতি ভক্তি নিদর্শনের উদ্দেশ্যে তাপনিয়ন্ত্রিত ইমারত হিসেবে তোহাখানা নির্মাণ করেন।
জনশ্রুতি আছে যে-শাহ সুজা যখন ফিরোজপুরে উনার শায়েখ শাহ নিয়ামতউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসতেন তখন উক্ত ইমারতের মধ্যবর্তী সুপ্রশস্ত কামরাটিতে বাস করতেন। তোহাখানা কমপ্লেক্সের ভেতরে আরো নাম না জানা অনেক মাজার দেখা যায়। যাদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। তবে এদেরকে হযরত শাহ সাইয়্যিদ নিয়ামতউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার খাদেম বা সহচর বলে ধারণা করা হয়।
ঐতিহাসিক মসজিদের ভূমি নকশা:
ইটের তৈরি এ ঐতিহাসিক মসজিদটি একটি নিচু খিলানকৃত প্রাচীর ঘেরা প্রাঙ্গণের পশ্চিম প্রান্তে স্থাপিত। মসজিদের প্রাচীরের পূর্ব দিকে একটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। বাইরের দিকে মসজিদটির পরিমাপ ১৯.৮১ মি. দ্ধ৭.৬২ মি.। মসজিদের বুরুজগুলি বিভিন্ন কলস শীর্ষ চূড়া শোভিত।
দুটি আড়াআড়ি খিলান আয়তাকার মসজিদ অভ্যন্তরকে তিনটি সমান বর্গাকার ‘বে’তে বিভক্ত করেছে। প্রতিটি ‘বে’ উপরে গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। আড়াআড়ি খিলান দু’টি ও এদের কোণের ত্রিভুজাকৃতি পেন্ডেন্টিভ তিনটি গম্বুজের ভার বহন করছে। পেন্ডেটিভ হলো, গম্বুজ এবং গম্বুজাকৃতির ছাঁদের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য নির্মাণ করা এক ধরনের ত্রিভুজীয় অংশ। গোলাকার ড্রামের উপর স্থাপিত গম্বুজগুলির শীর্ষ পদ্ম ও কলসের অলংকরণ অঙ্কিত করা হয়েছে। পূর্ব দেওয়ালের খিলানপথ বরাবর ক্বিবলা দেওয়ালে রয়েছে তিনটি মিহরাব। অষ্টভুজাকৃতির কেন্দ্রীয় মিহরাবটি পার্শ্ববর্তী মিহরাব কুলুঙ্গিদ্বয় অপেক্ষা বড় এবং সামনের দিকে সামান্য আয়তাকার কাঠামোর মধ্যে ন্যস্ত।
মসজিদ অভ্যন্তরে চারদিকের দেওয়াল আয়তাকার ও বর্গাকার প্যানেল নকশায় শোভিত। মিহরাব কুলুঙ্গি ছাড়াও মসজিদ অভ্যন্তরে বাড়তি কিছু কুলুঙ্গি রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবের উত্তর দিকে অবস্থিত এরকমই একটি কুলুঙ্গি অস্বাভাবিকভাবে উঁচু ও প্রশস্ত। কুলুঙ্গি হলো মূল ভবন থেকে কিছুটা বেড়িয়ে থাকা বদ্ধ জানালার মতো দেখতে। তিনধাপ বিশিষ্ট মিম্বর সম্বলিত কুলুঙ্গিটির শীর্ষ অর্ধ-গম্বুজ দ্বারা খিলানকৃত। অর্ধ-গম্বুজ শীর্ষটি মুকারনাস (এক ধরনের ইসলামিক নান্দনিক শিল্পকর্ম) নকশাতে অসাধারণভাবে অলঙ্কৃত।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বেশ কয়েকবার সংস্কারের বদৌলতে মসজিদটি বর্তমানে বেশ ভাল অবস্থায় বিদ্যমান।
সূত্র: বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া।
-মুহম্মদ নাঈম।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণে মুসলমানদের অবদান
২৩ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
মালয়েশিয়ার ঐতিহাসিক মসজিদ “মসজিদ নেগারা”
১৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
যে মসজিদ থেকে গভীর রাতে ভেসে আসতো যিকিরের আওয়াজ
০৯ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৮)
০৮ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
সাইয়্যিদ হযরত শাহ মখদুম রুপোশ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাজার শরীফ
০২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
বয়নশিল্প নিদর্শনে মুসলমানগণ (৬)
২৬ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
বয়নশিল্প নিদর্শনে মুসলমানগণ (৫)
১৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
বয়নশিল্প নিদর্শনে মুসলমানগণ (৪)
১২ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
বয়নশিল্প নিদর্শনে মুসলমানগণ (৩)
০৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
বয়নশিল্প নিদর্শনে মুসলমানগণ (২)
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
স্থাপত্যশৈলীর অনন্য স্থাপনা মানিকগঞ্জের ‘ওয়াসি মহল’
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
বয়নশিল্প নিদর্শনে মুসলমানগণ (১)
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার)












