মুসলমানদের বিচার ব্যবস্থা চুরি করেই গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ, গ্রীক ও রোমানদের আইন ব্যবস্থা
দেড়শ বছর আগের ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয় যে, গ্রিক কিংবা রোমানদের থেকে এই ভূখ-ের বিচার ব্যবস্থা রূপ লাভ করেনি
, ১৬ রবীউল আউওয়াল শরীফ, ১৪৪৭ হিজরী সন, ১২ রবি’, ১৩৯৩ শামসী সন , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রি:, ২৫ ভাদ্র, ১৪৩২ ফসলী সন, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) ইতিহাস
ইতিহাস অনুযায়ী, এ অঞ্চলে সভ্য জাতি ছিলো মুসলমানগণ। যে কারণে ব্রিটিশরা পলাশীর যুদ্ধে ক্ষমতা দখলের পরও এ অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিলো। ব্রিটিশদের আমলেও এ অঞ্চলের বিচারব্যবস্থার ভিত্তি ছিলো শরীয়াহ আইন। এ প্রসঙ্গে গবেষক ড. ওয়াকিল আহমদ তার ‘বাংলার মুসলিম বুদ্ধিজীবী’ বইয়ের ১০৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-
“হযরত আওরঙ্গজেব রহমতুল্লাহি আলাইহি যে শরীয়তী আইন প্রবর্তন করেন যার ফল “ফতোয়া ই আলমগীরী” নামক বিধানপুস্তক, সাধারণত তারই অনুসরণে বিচার ও শাসন ব্যবস্থা ১৭৯০ সাল পর্যন্ত কোম্পানী অব্যাহত রাখে। ফৌজদারী ও দেওয়ানি আদালতে কাজী, মৌলভী, দারোগা, মুফতি প্রভৃতি বিচার ও আইনের ব্যাখ্যাদাতার প্রাধান্য থেকে যায়। ১৭৯০ সালে কর্নওয়ালিস মুসলিম দ-বিধিতে (গঁংষরস চবহধষ খধ)ি কিছু পরিবর্তন এনে ইউরোপীয় আইন প্রবর্তন করে। সকল প্রকার খুনের অপরাধে মৃত্যুদ- ও চুরি-ডাকাতির অপরাধে হাত-পা না কেটে সশ্রম কারাদ- প্রদান এরূপ পরিবর্তনের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ১৭৯৩ সালে ‘কর্নওয়ালিস কোড’-এ মুসলিম আইনের ক্ষেত্রে কিছু পুনর্বিন্যাস করা হয়, তবে কোন মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়নি। ”
অর্থাৎ এ অঞ্চলে ইংরেজ আইনও প্রবর্তিত হয়েছে মুসলিম শাসনামল থেকে চলে আসা মুসলিম আইনের ধারাগুলোকে নকল করে, রোমান আইন থেকে এ অঞ্চলের বিচারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়নি। এটিই তো স্বাভাবিক, কারণ অসভ্য ইংরেজ নৌ-দস্যুরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে কোথা থেকে? যারা শরীয়াহ আইন উনার কথা শুনলে অবজ্ঞা করে, তারা ইউরোপীয় আইনগুলো নিয়ে একটু ঘাটলেও দেখতে পাবে যে সেগুলো সবই শরীয়াহ আইন উনার ধারা থেকে নকল করেই নেয়া হয়েছে। মূলত শরীয়াহ আইনই বিশ্বের সমস্ত আইনের মাতা।
সুতরাং কথিত রোমান আইনের দোহাই দিয়ে যারা গ্রিক মূর্তিকে পূজনীয় দাবি করছে, তারা ইতিহাসজ্ঞানহীন গ-মূর্খ ছাড়া কিছুই নয়। আমাদের দেশে আইনের যে দুটি প্রধান ধারা, ফৌজদারি ও দেওয়ানী, এই নামগুলোই তো আরবী-ফারসী থেকে আগত। শুধু আইন নয়, বিচারবিভাগ বলতেই তখন মুসলমান কাজী-মুফতির এজলাসকে বোঝানো হতো। কোম্পানী আমলে বিচার বিভাগে মুসলিম প্রাধান্য সম্পর্কে ধারণা দিতে ড. ওয়াকিল আহমদ বাংলার বিভিন্ন শহর ও মফস্বল আদালতের কর্মকর্তাদের তালিকা তার বইতে তুলে ধরেছেন। যেমন ১৭৭২ সালে কলকাতার নিজামত আদালতের বিচারবিভাগীর কর্মকর্তাদের তালিকাটি নিম্নরূপ-
সদরুল হক খান, দারোগা; মুহম্মদ শাকির খান, কাজী আল কুজ্জাত; আহমদ আলী, মুফতি; মুহম্মদ ফাজিল, মৌলভী; মুহম্মদ সাজিদ, মৌলভী; মীর বুজরুগ আলী, মৌলভী।
অর্থাৎ হিন্দু অধ্যুষিত কলকাতা শহরেও বিচারবিভাগ ছিলো সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে। সিপাহী বিদ্রোহের পরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশরা হিংস্র নীতি অবলম্বন করে এবং মুসলমানদেরকে সমস্ত সরকারি ও প্রশাসনিক পদ থেকে অপসারণ করা শুরু করে। যে বিচার ব্যবস্থার পুরোধা ছিলো মুসলমানগণ, সেখান থেকে মুসলমান কাজী ও মুফতিদের অপসারণ করা হয়। যে প্রসঙ্গে কট্টর ইসলামবিদ্বেষী হান্টার তার ১৮৭১ সালে রচিত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইতে লিখেছে- “বর্তমানে যারা জীবিত তাদের সকলেরই মনে আছে যে, আইনের এই পেশাটা সম্পূর্ণভাবে মুসলমানদেরই করায়ত্ত্ব ছিলো। ”
ইংরেজদের নিকট থেকে ‘নওয়াব’ উপাধি প্রাপ্ত আবদুল লতিফ এ প্রসঙ্গে তার আত্মজীবনীতে লিখেছে- “১৮৬৪ সালের ১১ নং আইন দ্বারা কাজীউল কুজ্জাত, মুসলিম আইন অফিসার এবং শহর ও মফস্বলের কাজীর পদ উঠিয়ে দেয়া হয়। এই বিধানের ফলে বহু শিক্ষিত মুসলমান কর্মচ্যুত হন। অনেকের রুজী রোজগারের একমাত্র অবলম্বন ছিলো এই পেশা। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের এই ক্ষতি ছাড়াও সমগ্র মুসলমান সমাজ এজন্য বিশেষভাবে অবলম্বনহীন হয়ে পড়ে। ” (সূত্র: মুসলিম বাঙ্গলা আমার যুগে, দিব্যপ্রকাশ, পৃষ্ঠা ২৭)
আবদুল লতিফ ব্রিটিশ অনুগত ব্যক্তি হিসেবে ব্রিটিশদের সরাসরি প্রতিবাদ করেনি, বরং ব্রিটিশদের পরামর্শ দিলো যেন চাকরিচ্যুত কাজীদেরকে ‘ম্যারিজ রেজিস্ট্রার’ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তার ভাষায়, “যে সমস্ত লোক কাজীর পদ থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন, তারা এর ফলে জীবিকা অর্জনের সুযোগ পেলেন। ”
যে কাজীর রায়ে একদা মানুষের মৃত্যুদ- হতো, তাকে নামিয়ে আনা হলো কেবল বিয়ে পড়ানো ও রেজিস্ট্রারের ভূমিকায়। এ কারণে যেখানে ‘কাজী’ শব্দ দ্বারা ইসলামী পরিভাষায় বিচারককে বোঝানো হয়, সেখানে উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘কাজী’ বলতে বোঝায় বিয়ে পড়ানো মৌলভীকে।
১৮৬৪ সাল পর্যন্ত তথা বর্তমান সময় থেকে মাত্র দেড়শ বছর আগেও মুসলিম কাজী, মুফতি ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা এই উপমহাদেশের বিচার ব্যবস্থা পরিচালিত হয়েছে। মাত্র দেড়শ বছর আগেও শরীয়াহ আইনই ছিলো এই উপমহাদেশের বিচারব্যবস্থার ভিত্তি। সুতরাং যেসব জাহিলের দল গ্রিক মূর্তিকে এদেশের বিচারব্যবস্থার প্রতীক হিসেবে দাবি করছে, তারা মাত্র দেড়শ বছর আগের ইতিহাসও ঠিকমতো জানে না। তারা পশ্চিমাদের দালাল, দেশদ্রোহী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কেমন ছিলো মোঘল সালতানাতের গোলন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
পান্থনিবাস ও সরাইখানা নির্মাণে মুসলমানদের অনবদ্য অবদান
২৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৯)
১৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার বিরোধিতায় বিধর্মী-অমুসলিমরা
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার হিন্দু ধনিক-বণিক, বেনিয়া শ্রেণী, ব্যাংকার প্রভৃতির সাথে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইউরোপকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন আফ্রিকান মুসলমানরা
১২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
গুজরাটের সুলতান মুজাফফর শাহের পরহেজগারিতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ
০২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৭)
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
কেমন ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ঐতিহাসিক মুসলিমবাগ ঈদগাহ-ই কি আজকের ঢাকেশ্বরী মন্দির?
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
১২টি চন্দ্রমাসের নাম এবং নামকরণের সার্থকতা (২)
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ঐতিহাসিক খেমকারান যুদ্ধ: যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের উদ্ভব
২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)












