বাংলার মুসলিম কৃষকদের উপর হিন্দু জমি দখলদারদের জুলুমের ইতিহাস (পর্ব ১৩)
, ২৯ যিলক্বদ শরীফ, ১৪৪৬ হিজরী সন, ২৯ ছানী আ’শার, ১৩৯২ শামসী সন , ২৮ মে, ২০২৫ খ্রি:, ১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ ফসলী সন, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) ইতিহাস
উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িক পত্র গ্রন্থের দশম খন্ডের ৭০ পৃষ্ঠায় মুনতাসীর মামুন কলকাতার সংবাদপত্র অমৃতবাজার পত্রিকা ১ জুলাই ১৮৬৯ সালের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণ হিন্দু জমি দখলদারদের অত্যাচার নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে লিখেছে, ‘আমাদের দেশের কৃষকের ন্যায় ঘোর পরিশ্রমী জাতি পৃথিবীর মধ্যে দৃষ্ট হবে না। (আর কোথাও দেখা যাবে না).... এইঘোর পরিশ্রমের ফল কি! শোচনীয় দৈন্যতা! কৃষক মাত্রই প্রায় অন্ন ও বস্ত্রহীন, গৃহহীন বললেও অত্যুক্তি হয় না। অধিকাংশেরই পর্ণ কুটিরে বাস করতে হয়, সকলের ঘরে আবার আবশ্যকীয় খড়ও নাই। একটি পরিধেয় বস্ত্র ছাড়া দ্বিতীয় বস্ত্র কারো ভাগ্যে জুটতো না।
প্রায় সকল কৃষকই অনশনে (না খেয়ে) দিনাতিপাত করতো, অনেক সময় না খেয়েই ১২ ঘন্টা পর্যন্ত পরিশ্রম করতে হতো। আমাদের শুনলে আতঙ্ক লাগতো, কিন্তু এই হতভাগাদের প্রতিদিন এই রূপে কাটাতে হতো।’
এ সম্পর্কে বিনয় ঘোষ তার বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা গ্রন্থের ২১ পৃষ্ঠায় লিখেছে, ‘১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে যখন এই গুরুদায়িত্ব হিন্দুত্ববাদীদের দেওয়া হলো, তখন বাংলাদেশের অবস্থা কি ছিলো? এই বন্দোবস্তের আগেই ইংরেজদের রাজস্ব সংগ্রহের নানারকম কৌশল প্রয়োগের ফলে বাংলাদেশের কৃষকরাও চরম দুরাবস্থায় পৌঁছেছিলো। তার উপর ১৭৭০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ফলে বাংলার গ্রাম প্রায় বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছিলো বলা চলে।’
দুর্ভিক্ষের পরবর্তী বছরে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের কৃষকদের প্রায় তিনভাগের একভাগ অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছে।
উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িক পত্র গ্রন্থের দশম খন্ডের ৭১ পৃষ্ঠায় মুনতাসীর মামুন কলকাতার সংবাদপত্র অমৃতবাজার পত্রিকা ১ জুলাই ১৮৬৯ সালের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণ হিন্দু জমি দখলদারদের অত্যাচার নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে আরো লিখেছে, অধিকাংশ হিন্দু জমি দখলদাররাই প্রজাদের উপর নিপীড়ণ করে ও তাদের সর্বস্ব শোষণ করে নেয়। দু’টি উপায়ে উগ্র হিন্দু জমি দখলদাররা প্রজাদের অর্থ দ্বারা নিজেদের উদর পূর্ণ করে, তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা হলো-
প্রথমত, নিয়মিত খাজনা: এর আনুষাঙ্গিক অনেক কষ্টসাধ্য ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার আছে। যদি প্রজাদের খাজনা দিতে বিলম্ব হতো, তবে পেয়াদা নিযুক্ত করা হতো। পেয়াদারা হতভাগ্য প্রজাদেরকে কাছারীর বাটিতে ধরে এনে যারপর নাই অপমানিত করতো।
তারা প্রজাকে রৌদ্রে দাড় করিয়ে রাখতো, ব্যাপক মারপিট করতো ও কখনও জুতাপেটা পর্যন্ত করতে ছাড় দিতো না। বিলম্বের মাশুল হিসেবে পেয়াদারা কৃষকদের নিকট হতে ৪ আনা কেউ বা ৮ আনা করে অর্থ নিতো। উগ্র জমি দখলদাররা খাজনা ছাড়া জরিমানার নাম করে আরও কিছু অর্থ আদায় করে নিজেদের পকেট ভারী করতো। খাজনা দিতে অস্বীকার নয় বিলম্ব করলেই এরুপ নির্যাতন করা হতো।
দ্বিতীয়ত, ভিক্ষা: পিতা-মাতা, শশুর-শাশুড়ীদের ভরণ-পোষণ ও ছেলে-মেয়েদের বিবাহ উপলক্ষে কোন না কোন বাবদের অজুহাত দিয়ে প্রজাদের নিকট হতে প্রায়ই অর্থ আত্মসাৎ করতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী জমি দখলদার ‘ছোট লোকরা’।
আর প্রজারা খাজনা দিতে নিরুপায় হলে তাদেরকে দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করিয়ে খাজনা পরিশোধ করারও প্রমাণ পাওয়া যায়।
তৃতীয়ত, নজর: জমি দখলদারদের মাঝে ২ জমিদারিতে যারা চলাচল করে; তাদেরকে নজরস্বরূপ ১০ টাকা দিতে হতো।
চতুর্থ, বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাবদ অর্থ গ্রহণ: জমিদারির মধ্যে স্কুল, ডিস্মেন্সরি, পুস্করণী, বাঁধ এমনকি নিজেদের রাজনৈতিক কার্য পরিচালনাতেও জমিদারের বেশ লাভ আছে। এতে যে অর্থ ব্যয় হয় তার অতিরিক্ত অর্থ প্রজার নিকট হতে আদায় করে নেয়া হয়। জমি দখলদারদের অত্যাচার এখানেই শেষ না। আরো বিভিন্ন উপায়ে ও নতুন নতুন আইন জারী করে তারা প্রজাদের উপর কর চাপিয়ে দিতো। অনেক সময় ইচ্ছাকৃত মারামারি, সংঘাত, জমি দখল করার ফিতনা সৃষ্টি করে সালিশের নাম করে বিপুল অর্থ লুফে নিতো। এমনকি মামলা বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখতো। সহজে বিচার নিষ্পত্তি করতো না।
কলকাতার বর্ণ হিন্দু জমি দখলদারেরা বাংলাদেশের মুসলমান কৃষকদের উপরে জুলুম-অত্যাচার নির্যাতন করে যে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলো তার বর্ণনা তুলে ধরে ক্যামব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জয়া চ্যাটার্জী তার বইয়ের ৬৭ ও ৬৮ পৃষ্ঠায় বলেছে, এটা এভাবে বলা যেতে পারে যে, বাংলার ওপরে কলকাতা শহর যেভাবে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব করে থাকে ভারতের অন্য কোনো শহরে তার নিজের অঞ্চলের ওপরে তেমনভাবে কর্তৃত্ব করে না।
সে তাই বইয়ের ৬৮ পৃষ্ঠায় বলেছে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমির মালিকানা ও রায়তি স্বত্বের ক্ষেত্রে একটি জটিল অবস্থার উদ্ভব হয়। জমির এবং রাজস্ব জমাদানকারী জমিদারদের মাঝে একটি বিশাল মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির সৃষ্টি হয়। খাজনা আদায়ের বিস্তৃত ও প্রায় অপরিবর্তনীয় কাঠামোর গুরুভার বহন করা সত্ত্বেও কৃষকদের মাঝে এক শ্রেণীর লোক উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করে। এর ফলে সাধারণ রায়তদের তুলনায় তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় আর অন্যরা বর্গাদার বা বর্গাচাষি ও কৃষি শ্রমিকে পরিণত হয়। বাংলা ভাগ হল (হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশ বিভাগ ১৯৩২-১৯৪৭) জয়া চ্যাটার্জী, এল অ্যালমা পাবলিকেশনস, প্রথম সংস্করণ ১৯৯৯।
-মুহম্মদ মুশফিকুর রহমান।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কেমন ছিলো মোঘল সালতানাতের গোলন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
পান্থনিবাস ও সরাইখানা নির্মাণে মুসলমানদের অনবদ্য অবদান
২৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৯)
১৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার বিরোধিতায় বিধর্মী-অমুসলিমরা
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার হিন্দু ধনিক-বণিক, বেনিয়া শ্রেণী, ব্যাংকার প্রভৃতির সাথে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইউরোপকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন আফ্রিকান মুসলমানরা
১২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
গুজরাটের সুলতান মুজাফফর শাহের পরহেজগারিতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ
০২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৭)
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
কেমন ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ঐতিহাসিক মুসলিমবাগ ঈদগাহ-ই কি আজকের ঢাকেশ্বরী মন্দির?
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
১২টি চন্দ্রমাসের নাম এবং নামকরণের সার্থকতা (২)
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ঐতিহাসিক খেমকারান যুদ্ধ: যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের উদ্ভব
২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)












