মার্কিন-ইসরায়েলি শত বাধার মুখেও যেভাবে পরমাণু অস্ত্রের মালিক পাকিস্তান (২য় পর্ব)
, ২৬ মুহররমুল হারাম শরীফ, ১৪৪৭ হিজরী সন, ২৩ ছানী, ১৩৯৩ শামসী সন , ২২ জুলাই, ২০২৫ খ্রি:, ০৮ শ্রাবণ, ১৪৩২ ফসলী সন, ইয়াওমুছ ছুলাছা (মঙ্গলবার) ইতিহাস
গুপ্তহত্যার চেষ্টা এবং হুমকি-ধামকি:
১৯৭৯ সালের জুন মাসে ৮ ডেজ নামে খ্যাতনামা একটি ম্যাগাজিন নেদারল্যান্ডসের কোম্পানি ইউরেনকো থেকে পরমাণু অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ মেশিন সেন্ট্রিফিউজের নকশা চুরির বিষয়টি প্রকাশ করে। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়।
ডাচ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয়। এরপর দখলদার ইসরায়েল এর প্রতিবাদ জানায়। ১৯৮৩ সালে ডাচ আদালত গুপ্তচরবৃত্তির চেষ্টার অভিযোগে কাদির খানকে দোষী সাব্যস্ত করে। কিন্তু তাতে পারমাণবিক কর্মসূচির কাজ থামেনি। ১৯৮৬ সাল নাগাদ কাদির খান নিশ্চিত হয়ে যান যে, পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে সক্ষম।
এক্ষেত্রে খানের প্রেরণার জায়গাটা ছিলো আদর্শিক। তিনি মূলত ব্রিটিশ-মার্কিনিদের একটা কড়া জবাব দিতে চেয়েছিলেন। যেটা তার একটা উক্তি থেকেই স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মার্কিন ও ব্রিটিশদের নাক উঁচু মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন করতে চাই, এই জারজরা কি ঈশ্বর-নিযুক্ত বিশ্বের অভিভাবক?’
আর তাই এই কাজে তাকে থামাতে কম চেষ্টা হয়নি। পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচিকে ধ্বংস করার জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালানো হয়েছিলো। যার মধ্যে ছিলো একের পর এক গুপ্তহত্যার চেষ্টা। ধারণা করা হয়, এই পরিকল্পনা করেছিলো দখলদার ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ।
এমনকি কাদির খানের সঙ্গে ব্যবসায় সম্পর্কে যুক্ত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকেও টার্গেট করা হয়। পশ্চিম জার্মানিতে খানের কাছে একটি ‘চিঠি বোমা’ পাঠানো হয়। সেই বোমা থেকে তিনি বাঁচলেও তার পোষা কুকুরটি নিহত হয়।
আরেকটি বোমা হামলায় পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে কাজ করা সুইস কোম্পানি কোরা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একজন সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়।
ইতিহাসবিদ বলেছে, পরমাণু বোমা তৈরি থেকে পাকিস্তানকে বিরত রাখার জন্য হুমকি ও গুপ্তহত্যার চেষ্টাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলো মোসাদ।
কোরা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক সিগফ্রাইড শার্টলার সুইস ফেডারেল পুলিশকে জানিয়েছিলো, মোসাদের এজেন্টরা তাকে এবং তার বিক্রয়কর্মীদের বারবার ফোন করেছিলো। সে আরও জানায়, ডেভিড নামে জার্মানিতে ইসরায়েলি দূতাবাসের একজন কর্মচারী তার সাথে যোগাযোগ করেছিলো, যে তাকে পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কিত ব্যবসা বন্ধ করতে বলেছিলো।
পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির সাবেক কর্মকর্তা ফিরোজ খান বলেন, ‘কোনো মুসলিম দেশ পরমাণু অস্ত্রের মালিক হোক তা ইসরায়েলিরা কখনই চায়নি। ’ হত্যাচেষ্টা ও হুমকি-ধামকিতে নিজেরা সফল না হতে না পেরে দখলদার ইসরায়েল এবার অন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে।
১৯৮০ এর দশকের শুরুর দিকে দখলদার ইসরায়েল ভারতকে প্রস্তাব দেয়, তারা উভয়ে মিলে একযোগে বোমা হামলা করে পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করবে। প্রথমদিকে এই হামলার অনুমোদনও দেয় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গান্ধী।
ভারতের গুজরাটের জামনগর বিমানঘাঁটি থেকে ইসরায়েলি এফ-১৬ ও এফ-১৫ যুদ্ধবিমান উড্ডয়ন এবং পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু গান্ধী পরে পিছু হটলে পরিকল্পনাটি ভেস্তে যায়।
এরপর ১৯৮৭ সালে গান্ধীর ছেলে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আমলে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল কৃষ্ণস্বামী পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর চেষ্টা করে যাতে ভারত ইসলামাবাদের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালাতে পারে। সে সামরিক মহড়ার জন্য পাকিস্তান সীমান্তে পাঁচ লক্ষ সেনা পাঠায়, সঙ্গে শত শত ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান।
কিন্তু তার এ পরিকল্পনা সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সঠিকভাবে অবহিত করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী যখন পুরো বিষয়টি জানতে পারে তখন এই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
ভারত ও দখলদার ইসরায়েল বিরোধিতা করলেও চীন গোপনে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছিলো। চীন পাকিস্তানিদের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম, ট্রিটিয়াম এমনকি বিজ্ঞানীও দিয়েছিলো।
পাকিস্তানের কর্মসূচি উন্মোচিত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কয়েক মাস পর সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করলে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সে।
১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র গোপনে পাকিস্তানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণও দেয় এবং তার কর্মসূচি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কিন্তু শীতল যুদ্ধের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলে যায়। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে ওয়াশিংটন ইসলামাবাদের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতিবাদে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়।
চাপের মুখে পাকিস্তান তখন বলেছিলো, তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি বন্ধ করবে। তবে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের উৎপাদন গোপনে অব্যাহত ছিলো যা পরে স্বীকার করেন কাদির খান। এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৯৮ সালের ১১ মে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে ভারত। এরপর সব প্রতিবন্ধকতা আর হুমকিকে পেছনে ফেলে ২৮ মে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে পাকিস্তান।
ভারত জায়গা করে নেয় ষষ্ঠ পারমাণবিক রাষ্ট্র হিসেবে এবং বিশ্বের সপ্তম পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হয় পাকিস্তান। পাকিস্তানের এই অর্জনের পর দেশটির নাগরিকদের কাছে জাতীয় বীর হয়ে ওঠেন কাদির খান।
-সংকলিত।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কেমন ছিলো মোঘল সালতানাতের গোলন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
পান্থনিবাস ও সরাইখানা নির্মাণে মুসলমানদের অনবদ্য অবদান
২৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৯)
১৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার বিরোধিতায় বিধর্মী-অমুসলিমরা
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার হিন্দু ধনিক-বণিক, বেনিয়া শ্রেণী, ব্যাংকার প্রভৃতির সাথে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইউরোপকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন আফ্রিকান মুসলমানরা
১২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
গুজরাটের সুলতান মুজাফফর শাহের পরহেজগারিতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ
০২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৭)
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
কেমন ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ঐতিহাসিক মুসলিমবাগ ঈদগাহ-ই কি আজকের ঢাকেশ্বরী মন্দির?
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
১২টি চন্দ্রমাসের নাম এবং নামকরণের সার্থকতা (২)
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ঐতিহাসিক খেমকারান যুদ্ধ: যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের উদ্ভব
২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)












