মার্কিন-ইসরায়েলি শত বাধার মুখেও যেভাবে পরমাণু অস্ত্রের মালিক পাকিস্তান (১ম পর্ব)
, ২৪ মুহররমুল হারাম শরীফ, ১৪৪৭ হিজরী সন, ২১ ছানী, ১৩৯৩ শামসী সন , ২০ জুলাই, ২০২৫ খ্রি:, ০৫ শ্রাবণ, ১৪৩২ ফসলী সন, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) ইতিহাস
পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির জনক আবদুল কাদির খান। জন্ম ১৯৩৬ সাল এবং মৃত্যু ২০২১ সাল। বয়স ৮৫ বছর।
এই পরমাণু বিজ্ঞানী পাকিস্তানে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য অন্য যে কারোর চেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, ইরান, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়াকেও তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তা করতে একটি অত্যাধুনিক ও গোপন আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কও পরিচালনা করতেন। এর মধ্যে উত্তর কোরিয়াই শেষ পর্যন্ত পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠতে সক্ষম হয়।
আবদুল কাদির খানের হাত ধরে পাকিস্তান যখন পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছিলো, তখন তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি জায়নবাদী ইসরায়েল ও তার অন্যতম সহযোগী মিত্র আমেরিকা। পাকিস্তান যাতে কখনও পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে না পারে সেজন্য আবদুল কাদির খানকে অসংখ্যবার হত্যা চেষ্টা ও পরমাণু কেন্দ্র ধ্বংসের চেষ্টা করে দখলদার পরগাছা।
যেমন ১৯৮০-এর দশকে দখলদার ইসরায়েল হিন্দুত্ববাদী ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলার পরিকল্পনা করে। পরে সে পরিকল্পনা থেকে ভারত সরকার সরে আসে।
আবদুল কাদির খান বিশ্বাস করতেন, পারমাণবিক বোমা তৈরি করে তিনি তার দেশকে বিদেশি হুমকি থেকে, বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারত থেকে রক্ষা করেছেন। আজ তার দেশের অনেক নাগরিকই এ ব্যাপারে একমত।
ভুট্টোর পরমাণু অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত:
পাকিস্তান প্রথমবারের মতো পরমাণু বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিবেশী দেশ ভারতের বোমা তৈরি করার পর। ১৯৭৪ সালের ১৮ মে ভারত তাদের প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে, যার প্রতীকী নাম ছিলো ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’।
সেই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো কোনো রকম দেরি না করেই তার দেশের জন্য পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিজ্ঞা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঘাস খাবো, পাতা খাবো, এমনকি প্রয়োজন হলে ক্ষুধার্তও থাকবো, কিন্তু আমরা আমাদের নিজস্ব একটি তৈরি করবোই। ’
পরমাণু শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘খ্রিস্টান বোমা আছে, ইহুদী বোমা আছে এবং এমনকি এখন হিন্দু বোমাও। তাহলে ইসলামী বোমা কেন নয়?’ আর তার এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করেন বিজ্ঞানী আবদুল কাদির খান।
১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল অবিভক্ত ভারতের ভোপালে জন্মগ্রহণ করা আবদুল কাদির খান দেশভাগের পর ১৯৫২ সালে পরিবারের সাথে পাকিস্তানে চলে যান। করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়ে ডিগ্রি নেয়ার পর উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৬০ সালে ইউরোপে পাড়ি জমান তিনি।
সেখানে ১৫ বছরের প্রবাস জীবনে তিনি টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট বার্লিন, নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অব ডেলফ্ট এবং বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব ল্যুভেন-এ পড়াশোনা করেন।
১৯৭৪ সাল নাগাদ কাদির খান নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামের একটি প্রধান পারমাণবিক জ্বালানি কোম্পানি ইউরেনকোতে কাজ করতেন। কোম্পানিটি ইউরোপীয় পারমাণবিক চুল্লির জন্য সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহ করতো।
কাদির খানের ইউরেনকোর সব গোপন এলাকা এবং বিশ্বের সেরা সেন্ট্রিফিউজের নকশাগুলোতে প্রবেশাধিকার ছিলো। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি হঠাৎ নেদারল্যান্ডস থেকে দেশে চলে আসেন। আসার আগে ইউরেনকোকে তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানে আমাকে এমন একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যা আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারবো না’।
অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়, ১৯৭৪ সালে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি নিয়ে ভুট্টোর সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে কাদির খান পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এর কিছুদিন পর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি নেদারল্যান্ডস থেকে ইউরেনিয়াম সেন্ট্রিফিউজের একটি নকশা চুরি করেছেন, যা ইউরেনিয়ামকে অস্ত্র-গ্রেড জ্বালানিতে রূপান্তর করতে পারে।
সে বছরই তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ নামে একটি গবেষণাগার স্থাপন করেন যা পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরি করে। কয়েক বছর ধরে এই কার্যক্রম গোপনে গোপনে পরিচালিত হয়। পরমাণু সমৃদ্ধকরণ ব্যবস্থা তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো ভুয়া কোম্পানির নামে আমদানি করা হয়।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কাদির খানের গবেষণা কাজে সমর্থন জানানোর উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে বেসামরিক সরকারগুলোকে এ ব্যাপারে অন্ধকারেই রাখা হয়েছিলো। শুধু ব্যতিক্রম ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো। কারণ তিনিই এই উদ্যোগের প্রস্তাব করেছিলেন।
আবদুল কাদির খান নিজ দেশের পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি ইরানকে এ ব্যাপারে সহায়তা করছিলেন। ভুট্টো বরাবরই বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। এমনকি নিজের কন্যা প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকেও এ সম্পর্কে কিছুই বলেননি।
বেনজির অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে প্রথমবারের এ সম্পর্কে জানতে পারেন ১৯৮৯ সালে। তাও নিজ দেশের ভেতরে নয়, ইরানের রাজধানী তেহরানে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইরানে বেনজিরের রাষ্ট্রীয় সফরকালে ইরানি প্রেসিডেন্ট রাফসান জানি তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তারা ‘বিশেষ প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত’ বিষয়ে দুই দেশের চুক্তি নবায়ন করতে পারেন কি না।
বিভ্রান্ত হয়ে বেনজির জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি ঠিক কী নিয়ে কথা বলছেন। ’ ‘পারমাণবিক প্রযুক্তি, ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রী, পারমাণবিক প্রযুক্তি,’ ইরানের প্রেসিডেন্ট উত্তর দেন। এ কথা শুনে হতবাক হয়ে যান প্রধানমন্ত্রী বেনজির।
-সংকলিত।
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কেমন ছিলো মোঘল সালতানাতের গোলন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
পান্থনিবাস ও সরাইখানা নির্মাণে মুসলমানদের অনবদ্য অবদান
২৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৯)
১৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার বিরোধিতায় বিধর্মী-অমুসলিমরা
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার হিন্দু ধনিক-বণিক, বেনিয়া শ্রেণী, ব্যাংকার প্রভৃতির সাথে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইউরোপকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন আফ্রিকান মুসলমানরা
১২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
গুজরাটের সুলতান মুজাফফর শাহের পরহেজগারিতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ
০২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৭)
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
কেমন ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ঐতিহাসিক মুসলিমবাগ ঈদগাহ-ই কি আজকের ঢাকেশ্বরী মন্দির?
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
১২টি চন্দ্রমাসের নাম এবং নামকরণের সার্থকতা (২)
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ঐতিহাসিক খেমকারান যুদ্ধ: যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের উদ্ভব
২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)












