ইতিহাস
‘মরুভূমির চিতা’ ফখরুদ্দীন পাশা: মদীনা মুনাওয়ারার সর্বশেষ উসমানী শাসক
, ২৭ জুলাই, ২০২৫ ১২:০০:০০ এএম ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) ইতিহাস
‘মরুভূমির চিতা’ ফখরুদ্দীন পাশা। তিনি ছিলেন উসমানীয় খিলাফতের সেই সাহসী জেনারেল, যিনি আরব বিশ্বাসঘাতক, ব্রিটেন এবং তার মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে টানা ৭২ দিন একাই লড়াই করেছিলেন। পরবর্তীতে উনার বীরত্ব ও সাহসিকতায় প্রভাবিত হয়ে উনাকে ‘টাইগার অব দ্যা ডেজার্ট’ তথা ‘মরুভূমির চিতা’ আখ্যা দেয়া হয়। ইতিহাস উনাকে ‘মুহাফিযে মদীনা’- ‘মদীনার রক্ষক’ নামে স্মরণ করে।
তিনি উসমানী খিলাফতের একজন সাহসী জেনারেল ছিলেন। তবে যে বিষয়টি উনার ব্যক্তিত্বকে বিখ্যাত করেছিলো তা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি উনার অগাধ মুহব্বত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন উসমানী খেলাফতের হাতে ব্রিটিশরা প্রায় সর্বত্র পরাজিত হচ্ছিলো, তখন তারা একটি ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। তারা হিজাজের গভর্ণর হুসাইন বিন আলীকে নিজেদের জোটে এ প্রলোভন দিয়ে নিয়ে আসে যে, যুদ্ধ শেষে তাকে মুসলমানদের খলীফা বানানো হবে। তখন গভর্ণর উসমানী খিলাফতের বিরুদ্ধে গাদ্দারী করে এবং মক্কা শরীফ ও জেদ্দা দখল করে নেয়।
এরপর সে মদীনা শরীফের দিকে অগ্রসর হয়। তার সাথে ছিলো ব্রিটিশ ও ফরাসি সেনাবাহিনী এবং লরেন্স অফ আরব নামের এক কুখ্যাত গুপ্তচর। তারা ১৯১৬ সালে মদীনা শরীফ অবরোধ করে। অবরোধটি ১৯১৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো। কারণ তারা এখানকার উসমানী মুজাহিদীনদের কঠোর প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছিলো।
তৎকালীন সময়ে মদীনা শহরের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ছিলো একজন উসমানী জেনারেলের তত্ত্বাবধানে। উনার নাম ‘ফখরী পাশা’ বা ‘উমর ফখরুদ্দীন পাশা’। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী এবং ঈমানদার ব্যক্তি। মদীনাবাসী উনার সাহসিকতা এবং অসাধারণ পরিচালনার জন্য উনাকে ভীষণ মুহব্বত করতো।
ফখরুদ্দীন পাশা ছিলেন মদীনা মুনাওয়ারার সর্বশেষ উসমানী শাসক। উনার শাসনকাল ১৯১৬ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত।
আরবদের বিশ্বাসঘাতকতা উসমানী খেলাফতের উপর মারাত্মক আঘাত করেছিলো। ফলে ব্রিটিশ ও তাদের মিত্রবাহিনী একের পর এক খেলাফতের অঞ্চল দখল করতে থাকে। উসমানীদের মিত্র বুলগেরিয়ার আত্মসমর্পণের পরে জার্মানিও আত্মসমর্পণ করে। ফলে শেষ পর্যন্ত উসমানী সালতানাতকেও ব্রিটেন ও তার মিত্রদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। ওই সময় হিজাজের গভর্ণর হুসাইন বিন আলী এবং তার পুত্র আলী, ফয়সাল এবং আবদুল্লাহ ভেবেছিলো, এই অবস্থায় এখন ফখরুদ্দীনও আত্মসমর্পণ করবেন এবং মদীনা শরীফ তাদের দখলে এসে পড়বে। কিন্তু ফখরুদ্দীন আত্মসমর্পণ না করে যুদ্ধ চালিয়ে যান।
মদীনা শহরে রসদ সরবরাহকারী ট্রেনটি ব্রিটিশরা বিকল করে দিয়েছিলো। ফলে বাইরে থেকে ফখরুদ্দীনের কাছে কোনও সাহায্য আসছিলো না। অবরোধের সময় মদীনা মুনাওয়ারায় ১৩০বার আক্রমণ করা হয় এবং ১৯১৮ সালের ৩০ এপ্রিল মদীনা শরীফের পবিত্র মাটিতে ৩০০টি বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিলো। খাবার সামগ্রী ফুরিয়ে গিয়েছিলো। খাবারের অভাবে ফখরুদ্দীন পাশা এবং উনার সেনাবাহিনী গাছের লতা-পাতা খেতে শুরু করলেন। কিন্তু তবুও তিনি অস্ত্র সমর্পণ করছিলেন না। কারণ উনাকে স্বপ্নে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আদেশ মুবারক করেছেন- “আত্মসমর্পণ করা যাবে না। ”
একজন তুর্কি লেখক লিখেছেন, ১৯১৮ সালের এক জুমুয়াবার ফখরুদ্দীন পাশা মসজিদে নববী শরীফে নামাযের সময় খুতবা দেওয়ার জন্য মিম্বর শরীফের সিঁড়িতে উঠতে শুরু করেছিলেন। তিনি অর্ধেক পথে থেমে যান এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্রতম রওজা মুবারকের দিকে চেহারা ফিরিয়ে উচ্চস্বরে বলেন, “ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আপনাকে কখনো ছেড়ে যাবো না। ”
এরপর তিনি নামাযী এবং মুজাহিদীনদের প্রতি আবেগদ্বীপ্ত কন্ঠে ভাষণ দেন- “হে আমার মুসলমান ভাইয়েরা! আমি তোমাদেরকে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক নিয়ে জিহাদের জন্য অনুরোধ করছি। যিনি এই সময়ে আমার সাক্ষীও। আমি তোমাদেরকে হুকুম করছি, শত্রুর শক্তির পরওয়া না করে উনার শহরকে সর্বশেষ বুলেটটি দিয়ে রক্ষা করো।
তুর্কি বাহিনীর সাহসী অফিসারগণ! ওহে ছোট্ট মুহম্মদীরা! সামনে অগ্রসর হও। আমার সঙ্গে মিলে মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সামনে ওয়াদা করো যে, আমরা আমাদের জীবন বিলিয়ে দিয়ে আমাদের ঈমানকে রক্ষা করবো। ”
এরপর ফখরী পাশা বলেন, উনাকে স্বপ্নযোগে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আদেশ মুবারক করেছেন, “তিনি যাতে কাফেরদের নিকট আত্মসমর্পণ না করেন। ”
(পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকুন। )
এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
-
কেমন ছিলো মোঘল সালতানাতের গোলন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
পান্থনিবাস ও সরাইখানা নির্মাণে মুসলমানদের অনবদ্য অবদান
২৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৯)
১৫ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার বিরোধিতায় বিধর্মী-অমুসলিমরা
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার হিন্দু ধনিক-বণিক, বেনিয়া শ্রেণী, ব্যাংকার প্রভৃতির সাথে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম
১৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল জুমুয়াহ (শুক্রবার) -
ইউরোপকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন আফ্রিকান মুসলমানরা
১২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
গুজরাটের সুলতান মুজাফফর শাহের পরহেজগারিতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ
০২ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আহাদ (রোববার) -
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা (৩৭)
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
কেমন ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
০১ নভেম্বর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার) -
ঐতিহাসিক মুসলিমবাগ ঈদগাহ-ই কি আজকের ঢাকেশ্বরী মন্দির?
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
১২টি চন্দ্রমাসের নাম এবং নামকরণের সার্থকতা (২)
২৯ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুল আরবিয়া (বুধবার) -
ঐতিহাসিক খেমকারান যুদ্ধ: যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের উদ্ভব
২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১২:০০ এএম, ইয়াওমুছ সাবত (শনিবার)












